কুমারটুলি ডায়েরি ২০২০: মা আসছে কঠিন সময়ে, পড়ছে মাটির প্রলেপ

কুমারটুলি ডায়েরি ২০২০

কুমারটুলি ডায়েরি ২০২০: লকডাউন আর আমপান জোরালো ধাক্কা কাটিয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে পরিস্থিতি। সিটি অব জয় ফিরছে সেই পুরোনো ছন্দে, লিখলেন জিকো রায়


ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে বাঙালির সবচেয়ে প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো। কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি অন্যরকম। পূজো হওয়া নিয়ে তৈরী হয়েছে সংশয়। আশ্বিন মাস আসবে, শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসবে, মৃদু হাওয়ায় দুলতে থাকা কাশফুলের মনোরম দৃশ্যও চোখে পড়বে, কিন্তু পূজো  কি হবে! আশ্বিনের শারদপ্রাতে শোনা যাবে কি জোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা?

এই প্রশ্নকে সঙ্গি করেই দুই বন্ধু মিলে ( বাইকে ) পাড়ি দিয়েছিলাম প্রতিমা তৈরির আঁতুরঘর কুমারটুলিতে। কারণ এখান থেকেই প্রাথমিকভাবে উত্তর মিলবে। কারণ এখানেই প্রতি বছর চিন্ময়ী মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি তৈরী হয় এবং তা ক্রমশ পৌঁছে যায় দেশ ও বিদেশের নানা প্রান্তে।

প্রায় তিনশো বছর ধরে কুমারটুলিতে মায়ের মূর্তি তৈরীর কাজ একই পরম্পরায় চলছে।। প্রতি বছর মাটি, কাঠামো, খড় আর কিছু অসামান্য শিল্পীদের হাতের নৈপুণ্যতার ছোঁয়ায় মাটির মূর্তিও জীবন্ত হয়ে ওঠে। মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বর আর কুমারটুলিতে মায়ের প্রতিমা নির্মাণ – এই দু’য়ের যুগলবন্দীতেই বাঙালির হৃদয়জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে পুজোর গন্ধ। সৃষ্টিশীল মায়ের মূর্তিগুলোকে ঘিরে হাজারো স্বপ্নের জাল বোনে প্রতিটি বাঙালি। মায়ের চক্ষুদান পর্বের ছোট্ট একটা ভিডিও ক্লিপ কিন্তু পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে থাকা বাঙালির আবেগকে হিমালয় পর্বতের উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে।

তবে এ বছর (২০২০) কুমারটুলির চিত্রটা খুবই অন্যরকম। অনেকটাই দুঃখের এবং কষ্টের। বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কুমারটুলি যে ভালো নেই তা জানতাম তবে এতটাও যে খারাপ অবস্থা দেখব তা আশা করিনি। গতবছর এই সময়েই এসেছিলাম কুমারটুলিতে। এ বছরও এলাম। কিন্তু গতবছরের সঙ্গে এই বছরের চিত্রটা কিছুতেই মেলাতে পারলাম না। সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র চোখে পড়লো।

প্লাস্টিকে মুখ ঢেকেছে বেশ কিছু প্রতিমার। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পরিচয়হীন কাঠামোগুলো। একটা-দুটো নয়, বেশ অনেকগুলো স্টুডিওই বন্ধ। মূর্তি তৈরীর সংখ্যা অনেকটাই কম। বড় ঠাকুর হাতে গোনা। যা তৈরী হচ্ছে তা সবই ছোটো এবং এক চালার।

কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম তাঁরা মানসিক এবং অর্থনৈতিক দুই দিক থেকেই খুবই ক্ষতিগ্রস্থ। মায়ের আগমনের অভাবে তাঁদের ঘরেও অন্ন-বস্ত্রের অভাব। সাহায্যের আশায় ( সরকারি ও বেসরকারি ) তারাও দিন গুনছে। দিন গুনছে মায়ের মূর্তি তৈরীর বায়না পেতে। দিন গুনছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া। দিন গুনছে আবার পরিচিত ছন্দে নিজেদের ফিরে পাওয়ার।

তবে আপাতত গোটা কুমারটুলি জুড়ে কেবল বিষন্নতার ছায়া। কারিগরদের অনুপস্থিতি, মায়ের মূর্তি তৈরীর বায়নার অভাব, ফাঁকা রাস্তা আর বন্ধ স্টুডিওর আড়ালে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে কয়েকশো মানুষ।

যদিও সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এবং ফোরাম ফর দুর্গোৎসবের মন্তব্যে দুর্গাপূজা নিয়ে খানিকটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। চিন্তার ভাঁজ থেকে মিলেছে মুক্তি। এবারে কুমোরটুলির বিষন্ন মুখে স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে তুলতে পূজো কমিটিগুলো এগিয়ে আসবে বলেই আমার বিশ্বাস। আবার আমরা পরিচিত ছন্দে দেখতে পাব কুমারটুলিকে। সময় যখন বদলাচ্ছে, তখন পরিস্থিতিও বদলাবে। কুমারটুলি জেগে উঠবে, মা দুর্গাও সেজে উঠবে। ছোটো করে হোক, অন্যরকমভাবে হোক, পূজো হবেই। আপনারা যেমন আশাবাদী, তেমনই আমিও আশা রাখি। মনখারাপের সমাপ্তিকরণ এবং শুভ সময়ের গোড়াপত্তন ঘটাতে মা আসছে। বিশ্বাস করুন, ভরসা রাখুন।

সঠিক সময়ে ঢাকের তালে শোনা যাবে আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনির যাত্রা, মর্ত্যলোকে জোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন কেবল সময়ের অপেক্ষা।

ছবি: জিকো রায়

(আরও ফিচার পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)