কুমোরটুলি ২০২০: ছন্দপতন নয়, পতন থেকে পুজোর ছন্দে ফেরার গল্প

কুমোরটুলি

কুমোরটুলি গিয়েছিলাম মাস দুয়েক আগে। করোনা, আমপান, লকডাউন, আনলক— সবাই মিলেমিশে তখন তাণ্ডব চালাচ্ছে যেন সেখানে। সেই সময় কুমোরটুলির জরাজীর্ণ দশা দেখে এসেছিলাম। তবে বিশ্বাস ছিল, কুমোরটুলি ফের ছন্দে ফিরবে। ছোট হোক বা বড়, হতে পারে অন্য রকম ভাবে, কিন্তু দুর্গাপুজো হবেই। তাই ফের গিয়েছিলাম কুমোরটুলিতে। নিজের চোখে দেখে এলাম কতটা ছন্দে ফিরেছে সে।— লিখলেন জিকো রায়


কুমোরটুলিতে ঢুকে মনটা একেবারে খুশিতে ভরে গেল। চোখে পড়ল সেই চেনা দৃশ্যগুলো। আট থেকে আশি, সবাই ভিড় করেছে কুমোরটুলিতে। করোনাকে ড্রিবল করে হাতে ক্যামেরা নিয়ে অনেকেই হাজির। নানা জায়গায় চলছে আগমনীর ফোটোশ্যুট। কর্মব্যস্ততা তুঙ্গে।

হাতে গোনা কয়েকটা দিন বাকি মায়ের আগমনের। তার আগে তো তাকে সাজিয়ে তুলতে হবে। এক জন শিল্পীর সমস্ত সত্ত্বাটুকু দিয়ে সেজে উঠবে মা দুগ্গা। চোখের নিমেষেই হয়ে উঠবে প্রাণবন্ত। এ বছর প্রতিমা তৈরির বরাত এসেছে দেরিতে। কারিগরের সংখ্যা অনেকটাই কম। গরিব-মধ্যবিত্ত ছাপোষা বাঙালির শেষ সম্বলটুকু দিয়েই জোরকদমে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। এ বছর পাঁচচালার চাইতে একচালার প্রতিমা তৈরির বায়না বেশি পেয়েছেন শিল্পীরা।

 

করোনা আবহে এ বছর বেশির ভাগ পুজো কমিটিরই বাজেট অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। অনেকেই ঝুঁকেছে একচালার প্রতিমার দিকে। হালের থিম পুজো এবং আধুনিক কালের পাচঁচালার প্রতিমাকে পাশে সরিয়ে রেখে যদি সময়ের সিঁড়ি বিয়ে অতীতে ফিরে যাওয়া যায়, তা হলে দেখা যাবে আমাদের পূর্বপুরুষদের আমলে একচালার প্রতিমাতেই মা দুর্গা বেশি পূজিত হতেন। যদিও একদম শুরুতে মায়ের মহিষাসুরমর্দিনী রূপ পাওয়া গেলেও একচালাতে ছেলেমেয়ে নিয়ে মাকে বেশি কাছের করে নিয়েছে আপামর বাঙালি। বনেদি বাড়ি বা বারোয়ারি— সর্ব ক্ষেত্রেই একচালার মধ্যেই মায়ের অবস্থান। পানপাতার মতো মুখ, কান পর্যন্ত টানা চোখ, গায়ের রং হলদেটে এবং সেই ভুবনভোলানো হাসিতে চিন্ময়ী মা মৃন্ময়ী রূপে আবির্ভূত হতেন মর্তে। মায়ের এই রূপকে বলা হয় বাংলা রীতির মুখ।

আর আধুনিককালে মায়ের যে রূপ এবং একচালার পরিবর্তে পাঁচচালার প্রতিমা আমরা দেখি, সেই পরিবর্তনটা কিন্তু হয়েছিল এই কুমোরটুলির হাত ধরেই। ১৯৪০-এ কুমোরটুলি সর্বজনিনের প্রতিমা গড়তে গিয়ে কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণির শিল্পী তথা কুমোরটুলির গোপেশ্বর পাল সর্ব প্রথম সাবেক প্রথা ভেঙে একচালার ঘরানা থেকে বেরিয়ে এসে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশকে আলাদা করে ফেলেন।

তার পর বাংলা রীতির মুখ বদলে প্রতিমার মুখে আনেন মানবিক রূপ। পরিবর্তন আসে মায়ের গায়ের রঙের। সাবেকি তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা দুর্গার সেই হলুদের সঙ্গে এ বার মিশল একটু গোলাপি, মানুষের গায়ের রঙের কাছাকাছি। ‘স্বর্গের দেবী’ হয়ে উঠল ‘মর্ত্যের মানবী’। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিমা যেমন পৌঁছে যায় তেমনি পৌঁছে যায় আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা-সহ আরও অনেক দেশে। আবার হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রাশিয়া থেকেও অনেক অনাবাসী বাঙালি এই কুমোরটুলিতে এসে দুর্গা প্রতিমা কিনে নিয়ে যান।

ফিরে আসাটা বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে। বাধার প্রাচীর পেরিয়ে সাফল্যের জয়গান গাওয়াটা আমরা রপ্ত করে ফেলেছি। খালি পায়ে ফুটবল মাঠে মোহনবাগানের ব্রিটিশ বধ, বিদেশের মাটিতে ইস্টবেঙ্গলের এশিয়ান কাপ জয়, ছদ্মবেশে নেতাজির বারে বারে অন্তর্ধান, বেহালার ছেলেটার দেশের জার্সিতে দুর্দান্ত কামব্যাকের পর বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট হওয়া, এই বাঙালি কি পারে না বলুন তো? সেদিন ওরা  পেরেছিল আর আজ কুমোরটুলি পেরেছে। এ বছরের চিত্রটা অনেকটা অন্য রকম হলেও কুমোরটুলি কিন্ত আজ নিজের মহিমায় বিরাজমান। হাজারো ধাক্কা সামলে কুমোরটুলি আছে কুমোরটুলিতেই।

—নিজস্ব চিত্র ও ভিডিও।

(আরও ফিচার পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)