অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁচে থাকবেন তাঁর নেতৃত্বে কাজ করা সাংবাদিকদের মধ্যে

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় নেই, খবরটা এক ধাক্কায় সব জীবন বোধকে গুলিয়ে দিল। গত কয়েকদিন ধরে বার বার প্রার্থণা করেছি আর বিশ্বাস করেছি সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে, কোভিডকে পরাস্ত করে ফিরে আসবেন অঞ্জনদা। প্রতিদিন খবর পাচ্ছিলাম, মাঝে মাঝে আশার আলোও দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু সব আশার শেষ। আর কখনও, কোনও দিন দেখা হবে না অঞ্জনদার সঙ্গে। আর কখনও একগাল হাসি হেসে বলবে না, ‘‘সুচরিতা এসেছিস? আয় এখানে এসে বস। কী খাবি বল?’’ বিদায় জানিয়ে আনন্দবাজার ডিজিটালের অফিস থেকে যখনই বেরতাম তখনই বলতেন, ‘‘যোগাযোগ রাখিস, সময় করে হোয়াটসঅ্যাপ করিস, ভাল লাগে।’’ এবার কাকে হোয়াটসঅ্যাপ করব অঞ্জনদা?

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার জীবনের সেরা বস। যাঁর সঙ্গে মতের আদান-প্রদান করা যেত, নিজের মত প্রতিষ্ঠা করার জন্য চিৎকার করা যেত। যে বসের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করা যেত। যে বসের কাছে অভিযোগ করা যেত, যাঁর কাছে আবেগ দেখানো যেত, আজ সেই মানুষটাই চলে গেলেন। শূন্য হয়ে গেল বাংলা সাংবাদিকতার একটা বড় অংশ। নিঃস্ব হলাম আমরা। বস হয়ে পাশে থাকা কাকে বলে অঞ্জনদা দেখিয়েছিলেন। যদি কখনও বস হই আপনার মতো হতে চাই অঞ্জনদা।

অঞ্জনদার সঙ্গে প্রথম দেখা ২০১৫ সালের অক্টোবর বা নভেম্বর হবে। ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম আনন্দবাজার ডিজিটালে। আনন্দবাজারের মূল বিল্ডিংয়ে তখন ছিল ডিজিটালের অফিস। বেশ খানিকক্ষণ স্বাভাবিক কথা, আলোচনা। প্রথা মেনে কোনও ইন্টারভিউ হয়নি। তার পর একটা কপি লিখতে দিলেন। জমা দিয়ে ফিরে এলাম। ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫ আনন্দবাজার ডিজিটালে যোগ দিলাম অঞ্জনদার নেতৃত্বে।

তিন বছরের থেকে দু’মাস কম ছিলাম। কিন্তু এই অল্প সময়ে আনন্দবাজার ডিজিটালে যে পরিবার, কাছের মানুষ তৈরি হয়েছে তা অঞ্জনদার প্রশ্রয়ে। এক সঙ্গে খাওয়া, কাজের ফাঁকে আড্ডা, পিছনে লাগা। আমার সতীর্থ অমৃত যখন অঞ্জনদার সামনে তাঁকেই নকল করে দেখাতেন অট্ট হাসিতে ফেটে পড়তেন অঞ্জনদা। এতটাই স্পোর্টিং ছিলেন। কারও জন্মদিন হলেই সামনের টেবল থেকে হুঙ্কার শোনা যেত আজ কী খাওয়া হচ্ছে?

অঞ্জনদা ছিলেন বলেই দিল্লিতে অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল বিশ্বকাপ কভার করতে যেতে পেরেছিলাম। আস্থা রেখেছিলেন, ছেড়ে দিয়েছিলেন পুরোটাই। অভিমান হয়েছিল কোনও ফিডব্যাক না দেওয়ায়। পরে বুঝেছি, আসলে উনি বিশ্বাস রেখেছিলেন আমি সঠিক পথেই কাজ করে ফিরব। অঞ্জনদার সঙ্গে আর কাজ করা হল না। খুব ইচ্ছে ছিল আর একবার কাজ করার। অঞ্জনদার ৩৩ বছরের কর্ম জীবনে আমি পেয়েছিলাম মাত্র ৩ বছর কিন্তু সেটাই কয়েক যু্গের মতো অনুভূতি।

যেদিন আনন্দবাজার ডিজিটাল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বাড়ি থেকে অঞ্জনদাকে রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিলেন। আমি ধরিনি। হোয়াটসঅ্যাপ করে বলেছিলাম অফিস গিয়ে কথা বলছি। দেখে বুঝেছিলাম আমার রেজিগনেশন পেয়ে খুব অবাক হয়েছেন। কাছে বসিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কী হয়েছে আমাকে বল? কার উপর রাগ হয়েছে তোর বল আমি দেখছি।’’ এভাবে কোন বস বলে? বাবার মতো লেগেছিল সেদিন মানুষটাকে। তিন মাসের নোটিস পিরিয়ড ছিল। শেষ হওয়ার কয়েকদিন আগে আবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘এখনও সময় আছে আর একবার ভেবে দেখবি নাকি?’’

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম তাই আর থাকা হয়নি। তার পর গত বছর অঞ্জনদাও আনন্দবাজার ডিজিটাল ছেড়ে প্রথমে টিভি নাইন ও তার পর ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর পুরনো জায়গা ২৪ ঘণ্টায়। আবার টেলিভিশনে সেই দাপুটে অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখতে পাচ্ছিল‌াম রোজ। শেষ হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়েছে, মার্চে। একটা জিনিস পাঠিয়েছিলাম, তার জবাবে লিখেছিলেন, ‘‘ওকে রে।’’ ব্যাস ওটাই শেষ কথা।

আনন্দবাজার ডিজিটাল ছাড়ার পর বার বার ওই বাড়িটায় যেতাম শুধু ওই মানুষটার আন্তরিকতার জন্য। এখনও অঞ্জনদার হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাসে জ্বলজ্বল করছে, ‘‘চারদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন।’’ তাতে ভেসে বড্ড দূরে চলে গেলেন অঞ্জনদা। দেখা হবে জীবনের ওপাড়ে কখনও তখন এর জবাব চাইব।

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)