Jnaneswari Express ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার এক যুগ পার ২০১০-২০২২

Jnaneswari Express:

জিকো রায়: সময়টা নভেম্বরের ২০১৯-এর মাঝামাঝি। আমার বন্ধুদেরকে জ্ঞানেশরীর (Jnaneswari Express) বিষয়টা জানালাম। সকাল ১০টায় হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে ঝাড়গ্রাম স্টেশনে নামলাম প্রায় দুপুর ১.১০ নাগাদ। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। প্রায় দুটো নাগাদ আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা এবং আমাদের এক বন্ধুর অফিসের কলিগ দীনেশ মুন্ডা। তার পর ঝাড়গ্রাম থেকে ট্রেনে চাপলাম। যাওয়ার পথেই চোখে পড়লো দুমড়ে-মুছরে যাওয়া দুর্ঘটনাগ্রস্ত কামরাগুলো। যত এগোচ্ছি ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা ততই বেড়ে চলেছে। ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম সরডিহা রেল স্টেশনে। স্টেশনের বাইরে থাকা টোটো নিয়ে আমাদের গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে চললাম। যেতে যেতে দেখলাম দু’দিকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তৈরি এই রেল স্টেশন।

টোটোচালকও জানালেন তাঁরাও বিশ্বাস করেন এই কামরাগুলোতে আত্মার আনাগোনা রয়েছে। রাতে নানা রকমের শব্দ শোনা যায়। যেমন শিশুদের কান্না, পুরুষ-মহিলার বুকফাটা আর্তনাদ, ট্রেনের কামরা থেকে নির্গত বিভিন্ন বর্ণের আলো চোখে পড়েছে অনেক গ্রামবাসীর। ওখানের রাস্তা দিয়ে রাত্রি বেলায় গেলে কারা যেন পিছু ডাকে। এমনকি ট্রেনের চালকা দেখেছেন ট্র্যাকের উপর দিয়ে মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। ট্রেন থামিয়ে নেমে দেখে কেউ নেই।  টোটোচালক এটাও বললেন যে ওই জঙ্গলগুলো থেকে যে কোনও সময় হাতি বেরিয়ে আসতে পারে। সারাদিনে একবার তারা বের হয়। এইসব শুনছি আর প্রতি মুহূর্তে উত্তেজনার পারদ চড়ছে।

চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি রেল লাইনের দু’পাশে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতির ছাপ আজও রয়ে গিয়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে কামরাগুলো। একদিকে কিছু বেশি, একদিকে সংখ্যাটা কম। এবার আমরা যেদিকে কামরার সংখ্যা বেশি সেদিকে এগিয়ে চললাম। রেললাইন পেরিয়েই দেখলাম এদিক ওদিক বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে ট্রেনের নানান অংশ। জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের ভাঙা অংশগুলো দেখে মনে হচ্ছে কারা জেন ফালাফালা করে দিয়েছিল ট্রেনটাকে। ট্রেনের প্রত্যেকটা অংশকে যেন তারা খুবলে তুলে এনে বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। প্রতিটা কামরার ওই ভয়ানক অবস্থা দেখে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল কামরার ভেতরে থাকা মানুষগুলোর করুন পরিণতি। প্রতিটা কামরার গায়ে মরচে ধরেছে. তবে সেটা রক্তের দাগও হতে পারে। কারণ দুটো দাগ কে সেই সময় আলাদা করে বোঝার উপায় ছিল না।

janaJnaneswari Express

কামরা গুলোর ভেতরে ঢুকতেই দৃশ্য দেখে মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো, কি খারাপ অবস্থা! আরও একবার শিহরিত হলাম এই ভেবে যে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা কতটা ভয়ঙ্কর ছিল যার ফলে ট্রেনের কামড়াগুলোর এই অবস্থা হতে পারে! ট্রেনের মেঝে হেলে পড়েছে, বসার জায়গা ভেঙে খুলে পরে রয়েছে , জানলার কাঁচ ভেঙে মেঝে এবং সিটের উপর পরে রয়েছে অ্যাভেঞ্জার্স-এর হাল্ক এসে সব কিছুকে যেন পিষে দিয়ে চলে গিয়েছে। আমরা অন্যতম ভুতুড়ে কামরা বলে পরিচিত এস-ফাইভ-এ ঢুকলাম এবং সেখানে সেই বাটিটা (যার গল্প আগে শুনেছি) খুঁজে পেলাম। একটা জায়গায় রেখেও দিলাম এবং ঠিক করলাম যে রাতের অন্ধকারে ফিরে এসে দেখবো বাটির অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে কিনা।

সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম এস-সেভেন কামরাতে। এই কামরা নিয়েই যত রহস্য। কারণ এই কামরাতে উঠলেই নাকি অনুভব করা যায় যে কামরা দুলছে। বিষয়টা যে কোনও ভৌতিক নয় সেরকম বিশ্বাস আমাদের ছিল। একজন একজন করে কামরায় সবাই উঠলাম। কয়েক সেকেন্ড কামরায় দাঁড়ানোর পর অনুভব করলাম কামরা ভীষণ রকমভাবে একদিকে দুলছে এবং একদিকে হেলে পড়ছে। আর কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ালেই উল্টে পরে যাবো মনে হচ্ছিল। দৌঁড়ে নিচে নেমে এলাম। যে বিশ্বাস নিয়ে কামরায় উঠেছিলাম সেই বিশ্বাস তো তলানিতে এসে ঠেকলো ! এ কি করে সম্ভব! ওই কামরা থেকে বেরিয়ে কামরার দিকে তাকিয়ে আছি আর নিজেরা আলোচনা করছি, এটা কি করে হল!

একটু ধাতস্ত হয়ে ঠিক করলাম আবার যাবো এস-সেভেন কামরায়। দু’জন উঠবে আর দু’জন বাইরে থাকবে। সত্য ও দীনেশ উঠলো, আমি আর কৌশিক বাইরে। কামরার ভেতরে ভাইব্রেশন তখনও হচ্ছে কিন্তু আগের চেয়ে কম। হালকা দুলছে। ওই মুহূর্তেই একটা ট্রেন পাস করলো। দুলুনি কিছুটা বেড়ে গেল। মাথা ঘোরাচ্ছে বলে সত্য আর দীনেশ নেমে পড়ল। বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কারণটা। সূয্যিমামা অস্ত গেল সে দিনের মতো, আমরা ফিরব আবার রাতে এই জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা হওয়া অভিশপ্ত কামরায়।

জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা হওয়ার পর থেকে সেই এলাকাটা রীতিমতো মতো পরিতক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ন’টা ছুঁইছুঁই। এবার সব কামরায় ঢোকার পালা। রাত তখন ১০টা বেজে গিয়েছে। এস-ফাইভে যখন ছিলাম তখন একটা ঘটনার কথা বলি— ক্যামেরা তখন বন্ধ। বন্ধু সত্য বলল, “আমরা ছাড়া এখানে কি আরও কেউ আছে নাকি রে! কাদের যেন ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ পেলাম হালকা।” চমকে উঠলাম ওর কথা শুনে। এ ছেলে কী বলছে এসব ! বললাম, ‘‘ঠিক শুনেছিস?’’ বলল, “হ্যাঁ, শুনেছি তবে হালকা, ভাসা ভাসা। পুরো ক্লিয়ার নয়।” বললাম, ‘‘ও কিছু না, মনের ভুল। এরকম পরিবেশে ওরকম মনে হয়।’’

বেশিক্ষন ভেতরে বসতে পারলাম না। বীভৎস গরম কামরার ভেতরে। প্রত্যেকটা কামরাতেই বাইরে ঠান্ডা কিন্তু কামরার ভেতরে গরম। কেমন যেন একটা গুমোট ভাব কামরাগুলোর মধ্যে. একটা ধুলোমাখানো গন্ধের বাতাবরণ ছেয়ে আছে। ঢুকলাম সেই কামরায় যে কামরায় বাটি রেখে এসেছিলাম। কিন্তু এ কি হল! সর্বনাশ করেছে! বাটি কোথায়! বাটি নেই, ভ্যানিশ, সিম্পলি ভ্যানিশ। এবার আমরা সত্যি ভয় পেলাম, তাহলে কি সত্যি! সত্যিই কি বাটির স্থান পরিবর্তন হয় নিজে থেকেই! আমরা এখানে সেই দুপুর থেকে রয়েছি। আমি বললাম, ‘‘চল বেরিয়ে যাই এখান থেকে। আমার কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে।’’ নেমেই যাচ্ছিলাম, সেই সময় সত্য বলল, ‘‘এই দাঁড়া দাঁড়া, এক মিনিট। বাটিটা তো এখানে থাকবে না। এটাই স্বাভাবিক। কারণ বাটিটা তো কামরার উল্টোদিকে রেখেছিলিস তুই। ভুলে গেলি!’’

Jnaneswari Express

উল্টোদিকে গিয়ে দেখলাম বাটি যেখানে রেখেছিলাম সেখানেই আছে। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আগেই পরিকল্পনা করা ছিল ঠিক রাত ১.২০-তে আমরা এস-সেভেন কামরায় যাব। ঘড়িতে দেখলাম সময় হয়ে গিয়েছে। আসলে আমরা ঠিক করেছিলাম যে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় নিহত সকল মানুষের আত্মার শান্তি কামনা করে ওই সময় জ্ঞানেশ্বরীর কোনও এক কামরায় মোমবাতি জ্বালাবো। এই সময়টা বেছে নিয়েছিলাম কারণ ২৮ মে ২০১০-এ ঠিক এই সময়েই জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা ঘটেছিল।

এস-সেভেনের দুলুনী রাতেও একই রকম রয়েছে। তার মধ্যেই আমি আর সত্য মোমবাতি জ্বালাবো বলে আর একটু ভেতরে ঢুকলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই দুলুনি বেড়ে গেল। আমি আর সত্য কামরার অন্য দরজা দিয়ে বেরোব বলে অনেকটাই এগিয়ে গিয়ে দেখি সেই দরজা এমন অবস্থায় রয়েছে যে ওখান দিয়ে বেরনো অসম্ভব। কৌশিক আর বিশ্বজিৎ ওদিকের দরজা দিয়ে নেমে গিয়েছে। আমরা আবার ঘুরে আসছি এদিকের দরজা দিয়ে নামবো বলে, আবার একটা দুলুনি. আমি আর টাল সামলাতে না পেরে বসে পড়লাম সিটে। সত্য রড ধরে কোনোরকমে টাল সামলাল।

যত রাত বাড়ছে রহস্য যেন বেশি করে ঘনীভূত হচ্ছে জ্ঞানেশ্বরীর প্রতিটা অংশে। তৎক্ষণাৎ কৌশিক আর বিশ্ব উঠে এসে আমাদের ধরে নামালো। কামরায় তখনও ভাইব্রেশন হচ্ছে। বুঝলাম এই কামরায় আমরাই দাঁড়াতে পারছি না তো স্বয়ং মোমবাতি কী করে দাঁড়াবে ! তাই সেখান থেকে নেমে অন্য একটা কামরায় মোমবাতি জ্বালানোর কাজটা সারলাম।

শেষবার যখন ঘড়ি দেখেছিলাম তখন প্রায় দুটো। কিছুক্ষণ পর সত্য বলল, এবার যাওয়া যাক। ঢুকলাম এস-সেভেনে। দুলছে কামরা। চারজন একসঙ্গেই ঢুকেছি। তাই ভালোই দুলছে। পাশের লাইন দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে, ফলে কামরার ভাইব্রেশন বেড়ে যাচ্ছে। পরমুহূর্তেই মনে হল আর এগোতে পারছি না। পড়ে যাবো, খুবই দুলছে। বাঁ দিকে হেলে পড়ছি আস্তে আস্তে। সত্য একপ্রকার ধমক দিয়েই আমাকে কামরার আরও ভেতরে নিয়ে গেল। যত এগোচ্ছি ততই কামরা দুলছে। কামরার শেষ প্রান্তের জানলা দিয়ে গাছের ডালপালা ভেতরে প্রবেশ করেছে। আর এগোনো যাবে না। আন্দাজ করলাম অনেকদিন পড়ে থাকার কারণে কামরার পার্টসগুলো ঝাঁঝড়া হয়ে গিয়েছে, অধিকাংশ জায়গা খুলে গিয়েছে, চাকা নেই. একদিকে হেলে রয়েছে। একদিকে হেলে থাকার কারণে ডিসব্যালান্স অবস্থায় আছে। তাই একটু ভার পড়লেই মধ্যাকর্ষণ বলের দরুন পড়ে যাবো বলে মনে হচ্ছে এবং কোনও ট্রেন বা ভারী গাড়ি গেলে ভাইব্রেশন হয় এই একই কারণে।

না, ভূতের দেখা পাইনি। কোনও আত্মা আমাদের বিপদে ফেলেনি। শুধু মনের কোণায় থেকে গিয়েছে একরাশ যন্ত্রণা। ওই মানুষগুলোর কষ্টের কথা যাঁরা ঘুমের মধ্যেই এই বিভৎসতার শিকার হয়েছিলেন। তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করি।

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: FacebookTwitterGoogle