‘ডেডলি সেকেন্ড ওয়েভ’, কতটা দায়ী কুম্ভমেলা আর বিধানসভা নির্বাচন

‘ডেডলি সেকেন্ড ওয়েভ’

‘ডেডলি সেকেন্ড ওয়েভ’ এই নামেই ব্যাখ্যা করা হচ্ছে ২০২১ কোভিড সংক্রমণকে। কিন্তু হওয়া উচিত ছিল উল্টোটাই। ২০২০ পুরো বছরটা কোভিড-১৯ ভাইরাসের সঙ্গে কাটানোর পর ২০২১-এও ফিরে আসা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা অনেক বেশি সহজ হতে পারত যদি গোটা দেশ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে না ভুগত। কী, কেন, কীভাবে, কোথায়—এই ভাইরাস নিয়ে এরকম নানান প্রশ্ন আজও রয়েছে। প্রতিদিন বদলাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের গবেষণার ফল। কখনও ছোঁয়া তো কখনও হাওয়া— এই ভাইরাসের উপস্থিতি যে আসলে কোথায় তাও এখনও নিশ্চিত নয়।  এই অবস্থায় সাধারণ মানুষের উপর ঠিক কতটা দায় বর্তায়? প্রশ্ন তুললেন সুচরিতা সেন চৌধুরী


নিজেদেরই আমরা সেই প্রশ্ন করতে পারি। আত্মবিশ্বাস থাকা ভাল কিন্তু তা অতিরিক্ত হয়ে গেলে ধ্বংসই ডেকে আনে, যা করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে হচ্ছে।  দেশের বেশ কিছু রাজ্যে প্রথম থেকেই মাস্ক পরায় একটা অনীহা দেখা গিয়েছে। সেই তালিকায় অবশ্যই শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ। প্রথম ওয়েভের সময় দেখা গিয়েছে, বাংলার বাজারগুলো উপচে পড়া ভিড়। মাছ, মাংস যেন কোনও দিন খাননি এঁরা।

এই তো পয়লা বৈশাখ গেল। বাজারগুলোতে উপচে পড়েছে ভিড় জামা-কাপড় কেনার। আরে, জীবনই যখন থাকবে না, তখন নতুন জামা-কাপড় দিয়ে হবে কী? আগে তো বাঁচতে হবে, তার পর সাজতে হবে। মৃতদেহকে তো একবারই সাজানো যেতে পারে। তাও কোভিড আক্রান্ত মৃতদেহকে সেটাও পারবেন না। নতুন জামা-কাপড় একবছর, দু’বছর না হলে নিত্যদিনের জীবনের কী সমস্যা হবে, একবার ভেবেই দেখুন না!

করোনাকালের কুম্ভমেলা

এই তো সেদিন কলকাতার লোকাল ট্রেনের লেডিস কামরার ঘটনা। একজন সবজি ব্যবসায়ী মহিলা কামরার একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ছুটে ছুটে মাস্ক না পরা মহিলাদের মাস্ক পরার অনুরোধ করছিলেন হাতজোড় করে। তাতেই রেগে আগুন বেশ কয়েকজন। সেই মহিলার উদ্দেশে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে মাস্ক না পরা মহিলাদের জিজ্ঞাস্য, ‘‘আপনি কি আমার বাড়ির লোক যে জ্ঞান দিচ্ছেন?’’ আসলে আপনি যে বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে নেই, সেটা ভুলে গিয়েছেন। তাই পাবলিক প্লেসে বসে মাস্ক না পরার মতো অপরাধ করলে পাবলিক বলবেই। সেই মহিলা তখন জবাবে বলেছিলেন, ‘‘আপনার মাস্ক না পরার জন্য যদি আমার কোভিড হয়, আমাকে কে দেখবে বলুন তো। আমি তো দিন আনি দিন খাই। ২০২০-তে না খেয়ে মরতে বসেছিলাম। আবারও!’’

আসলে পড়াশোনা শিখে বড় চাকরি করলেই সচেতনতা আসে না, সেটা আসে ভিতর থেকে। না হলে ওই ঠেলার নাম বাবাজি। আবার লকডাউন, মাস্ক না পরলে জরিমানা, রাস্তায় বেরলে জরিমানা ইত্যাদি তো থাকলই। সব দায় কি প্রশাসনের? প্রশাসন তো আমরা বানাই, তার পর যে অনেকটা বড় দায় আমাদের উপরও বর্তায়। সঠিক পথ যা ইতিমধ্যেই আমাদের কাছে পরিষ্কার, সেই পথে হাঁটার।

মমতার হুইলচেয়ারের সঙ্গে

করোনাকালে তৃণমূলের র‍্যালি।-ফাইলচিত্র

এর সঙ্গে বলে রাখা ভাল, প্রশাসনেরও অনেক বড় ভূমিকা থেকে গেল এ যাত্রায়। একে তো কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে এতগুলো রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন, বাংলায় তার উপর আটদফা। যে ভোট ঘিরে প্রতিদিন মানুষ কাতারে কাতারে রাস্তায় নামছে প্রচারে। গোটা এপ্রিল মাস ধরে চলছে সেই উৎসব। তা আটকানোর দায় ছিল প্রশাসনের। নির্বাচন কমিশনের ভাবা ‌উচিত ছিল কীভাবে ছোট করে আনা যায় পুরো ব্যবস্থাটাকে। না, যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন বাংলায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। আর কে ঠেকায় কোভিডকে?

প্রশাসনের দায় থাকছে, কেন আগে থেকে বন্ধ করা হল না কুম্ভস্নান? হরিদ্বারের গঙ্গায় যখন এক সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে ধর্মের নামে ডুব দিচ্ছিলেন মানুষগুলো, তখন কি তাঁরা একবারও ভেবেছিল মানুষ মারার ধর্ম হচ্ছে? তাঁরা ভাবেনি ঠিকই কিন্তু কেন আগে থেকে বন্ধ করা হল না কুম্ভস্নান? দায়িত্ব বর্তায় প্রশাসনের উপর। মনে রাখতে হবে এই দেশ আবেগে চলে। আপনি খুলে রেখেছেন মানেই সেখানে চলে যাওয়া যায়। সে যদি হয় আগ্নেয়গিরি তাতেও ঝাঁপ দেওয়া যায়। কুম্ভমেলা থেকে মানুষগুলো যে যাঁর রাজ্যে ফিরলেন কোভিডকে সঙ্গে নিয়ে, যেন হারানো ভাইকে খুঁজে পেয়েছে মেলায়। এর পর ছড়িয়ে দেবেন সবার মধ্যে প্রসাদের মতো।

করোনাকালে বিজেপির র‍্যালি—ফাইল চিত্র

হাস্যকর। আসলে হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে যন্ত্রণা। আমরা কি নিজেরা একটুও সচেতন হতে পারি না? এখনও মাস্কহীন ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাস্তায়। নিজে মরতে চাইলে কে আটকাবে? কিন্তু অন্যের ক্ষতি করার অধিকার আপনার যে নেই। তাই পাবলিক প্লেসে পাবলিকরাই রুখে দাঁড়ান মাস্কহীনদের বিরুদ্ধে। না হলে আবার কোটি কোটি মানুষ না খেতে পেয়ে মরবেন। যখন বন্ধ হয়ে যাবে ট্রেন চলাচল, বিমানের ওঠানামা। বন্ধ হয়ে যাবে বাজার, দোকান। দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে, তার প্রভাব যে আপনার উপরও পড়বে।

এখনও সময় আছে সচেতন হন, সচেতন হোক প্রশাসন। না হলে প্রতিটি নিঃশ্বাসে ঢুকে আসবে মারণ ভাইরাস। নিঃশ্বাস নিতেই যে ভয় করবে। তার উপর তো আর কিছু নেই। হিন্দিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘‘শ্বাস হ্যায় তো আশ হ্যায়।’’ বাংলায়, ‘‘যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।’’

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)