ঔরঙ্গজেব, এক ক্ষমতালোভী নিষ্ঠুর শাসকের পাগলপারা প্রেম

ঔরঙ্গজেবঔরঙ্গজেবের সমাধি ঔরঙ্গাবাদে।

ঔরঙ্গজেব মানেই সবার আগে কী মাথায় আসে? প্রেম নিশ্চই আসে না? কিন্তু তিনিও ছিলেন প্রেমিক। আজকের এই হানাহানির যুগে কিছুটা অযাচিতভাবেই না হয় সেই ইতিহাসকে ফিরে দেখা সাহানা মল্লিক চক্রবর্তীর কলমে…


ঔরঙ্গজেব নাকি প্রেমিক! ‘বাদশাহের প্রেম’ বলতে এককথায় উঠে আসে শাহজাহানের নাম। ‘প্রেমিক’ খেতাবটা তো একমাত্র তাঁকেই মানায়। প্রেমের স্মৃতিতে অমন একখানা তাজমহল গোটা পৃথিবীতে আর কে-ই বা গড়তে পেরেছে! তাই তো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রেমিকদের মধ্যে তাঁর নামটা আজও জ্বলজ্বল করছে। তাঁকে ছাড়া আর কোনও মোগল বাদশাহের প্রেম বলতে তো সেলিম-আনারকলির প্রেম। কিন্তু সে তো ইতিহাসের চাইতে বেশি জনপ্রিয় হিন্দি ছবির দৌলতে। কিন্তু ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতক, উদ্ধত, ধর্মোন্মাদ, ভ্রাতৃহন্তা হিসেবে যাঁর স্থানটা চিরতরের জন্য পাকা, তিনি যদি প্রেমে দেবদাস হয়ে যান, তবে কেমন হবে? না, কেউই বোধহয় তা কল্পনা করতে পারে না। কারণ, তিনি মন্দির ধ্বংসকারী, সঙ্গীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী ঔরঙ্গজেব, যিনি সিংহাসনের লোভে একের পর এক ভাইকে হত্যা করতে পারেন, বৃদ্ধ পিতাকে কারারুদ্ধ করতে পারেন, এমনকী বিশ্বাসঘাতক সন্দেহে নিজের কন্যাকেও বন্দী করতে পারেন। কিন্তু পাগলপারা প্রেম? তা-ও আবার সম্ভব!

কিন্তু বাস্তবে তেমনটাই হয়েছিল। তা-ও আবার এক ভিনধর্মী নারীর জন্য। ইতিহাস বলছে, বুরহানপুরের অন্তঃপুরে এক খ্রিস্টান দাসীর সঙ্গে ক্ষণস্থায়ী সেই প্রণয়কে কখনই ভুলতে পারেননি তিনি। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ক্যাথরিন ব্রাউন তাঁর ‘ডিড ঔরঙ্গজেব ব্যান মিউজিক (Did Aurangzeb Ban Music)’ বইতে ঔরঙ্গজেবের জীবনের এমনই এক অজানা দিকের কথা উল্লেখ করেছেন, যার সাক্ষ্য পাওয়া যায় মনুচি প্রমুখ সমকালীন বিদেশি পর্যটকদের লেখাতেও।

ঘটনাটা তখনকার, যখন তিনি মোগল সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠেননি। সবেমাত্র দাক্ষিণাত্যের দায়িত্ব পেয়েছেন। ১৬৩৬-এ দাক্ষিণাত্য জয়ের পরেই শাদী করেছেন দিলরাস বানু বেগমকে। এছাড়াও রয়েছেন আর এক বেগম নবাব বাঈ। বুরহানপুর তখন ‘দক্ষিণের প্রবেশদ্বার’ বলে পরিচিত। উল্লেখ্য, এখানেই তাঁর মা মুমতাজ মহলের মৃত্যু হয়েছিল। এই শহরেই দীর্ঘ ছ’মাস শায়িত ছিল মুমতাজের মৃতদেহ।

এখানেই ঔরঙ্গজেবের মাসী অর্থাৎ মুমতাজ মহলের বোনের বাড়ি। একদিন দাক্ষিণাত্য যাওয়ার পথে হঠাৎ করেই চলে এলেন বুরহানপুরে, মাসীর বাড়ি। আর সেখানে গিয়ে বাগানে বেড়াতে বেড়াতে দেখা পেলেন এক অপূর্ব সুন্দরী যুবতীর, যিনি তরুণ ঔরঙ্গজেবকে পাত্তা না দিয়েই মৃদুস্বরে গান গাইতে গাইতে গাছ থেকে পেড়ে নিলেন একটি আম। ব্যাস, দেখা মাত্রই কুপোকাত ক্ষমতালোভী তরুণের হৃদয়। কিন্তু সেকথা প্রকাশ করতে না পেরে একেবারেই গুম মেরে গেলেন। মাসীর কাছে অবশেষে ব্যক্ত করলেন মনের কথা। জানালেন, মেসো মীর খলিলের হারেমের খ্রিস্টান দাসী হীরাবাইয়ের প্রেমে তিনি পাগল। মাসীর উদ্যোগে কাছে পেলেন প্রণয়িণীকে। নিজের হারেমের অন্য এক দাসীর বিনিময়ে ঔরঙ্গজেবের হারেমভুক্ত হলেন হীরাবাঈ।

আকবরের আমল থেকেই হারেমের মেয়েদের তাঁদের জন্মভূমির নামের সঙ্গে মহল জুড়ে দেওয়ার যে রীতি চালু হয়েছিল, সেই অনুযায়ী হীরাবাঈয়ের নাম হল ‘জায়নাবাদী মহল’।

কিন্তু সে-ও যে সে মেয়ে নয়, তাঁর প্রতি ঔরঙ্গজেবের প্রেম সত্যি কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য রাখলেন শর্ত। জীবনে কোনওদিন মদ্যপান না করার শপথ নেওয়া ঔরঙ্গজেবকে বললেন, প্রেমের পরীক্ষা দিতে হবে, সুরার গ্লাসে চুমুক দিয়ে। ঔরঙ্গজেব তা করতেও রাজী হয়ে গেলেন, যদিও শপথ ভঙ্গ করতে দেননি হীরা, চুমুক দেওয়ার আগেই সরিয়ে নেন সুরাভর্তি গ্লাস। ১৬৫৩ সালের সেই প্রথম দেখা প্রেমের পূর্ণতা পেতে না পেতেই এক বছরের মধ্যেই অকাল মৃত্যু হল জায়নাবাদী মহলের। তাঁকে কবর দেওয়া হয় ঔরঙ্গাবাদ-এ।

(আরও ফিচার পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)

জায়নাবাদী মহলের এই অকালমৃত্যুর ঘটনাটি ঔরঙ্গজেবকে প্রচণ্ড আঘাত দিয়ে যায়। এমনকী, তাঁর দুঃখে চোখের জলও ফেলেছেন নিষ্ঠুর বলে পরিচিত শাহজাহানের এই পুত্রটি। কথিত আছে, এর পর থেকেই এককালের বীণাবাদক ঔরঙ্গজেব নিষিদ্ধ করে দেন সবরকম সঙ্গীত-বাদ্য। কারণ, হীরাবাঈ ছিলেন একাধারে সুগায়িকা ও নর্তকী। হীরাবাঈ তাঁর সঙ্গীত ও নৃত্যে ঔরঙ্গজেবকে এমন ভুলিয়ে রাখতেন যে নিত্যদিনের প্রার্থনাতেও বাদ পড়ে যেত ধর্মপ্রাণ ঔরঙ্গজেবের।

সমকালীন ইতালীয় পর্যটক নিকোলো মনুচি (১৬৩৯-১৭১৭) ঔরঙ্গজেবের জীবনের এই পর্যায়টিকে তুলে ধরেছেন এভাবেঃ ‘’ঔরঙ্গজেব তাঁর হারেমের এক নর্তকীর প্রেমে পড়েছিলেন এবং সেই নর্তকীর প্রতি প্রেমের গভীরতার কারণে তিনি কিছুদিনের জন্য নিজের প্রার্থনা এবং কঠোরতাকেও উপেক্ষা করেছিলেন। নিজের জীবনকে সঙ্গীত এবং নৃত্যে পরিপূর্ণ করে রেখেছিলেন। এমনকী সুরাপান পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন, সেই নর্তকীর প্রতি তাঁর প্রেমের প্রমাণ দিতে। তাঁরও মৃত্যু হয়।

তখনই ঔরঙ্গজেব কোনওদিন সুরাপান না করার এবং সঙ্গীত না শোনার ব্রত গ্রহণ করেন।” সমকালীন লেখকের সাক্ষ্য থেকেই বোঝা যায়, হীরাবাঈয়ের মৃত্যু কতখানি বিচলিত করেছিল ঔরঙ্গজেবকে। প্রেমে অন্ধ হয়ে ধর্মের প্রতি অবহেলার জন্যই যে তাঁর এমন পরিণতি, সেই আক্ষেপের কথাও জানা যায় মনুচির বর্ণনা থেকে।

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)

অষ্টাদশ শতাব্দীতে লেখা নবাব শামস উদ দৌলা শাহনওয়াজ খান ও তাঁর ছেলে আবদুল হায় খান-এর ‘মাসির-আল-উমারা’ থেকে জানা যায়, এই ঘটনা কানে গিয়েছিল বাদশাহ শাহজাহানেরও। আর বাদশাহের কানে তুলেছিলেন ভাইয়ের প্রতি স্নেহপ্রবণ দারাশিকো। ভাইয়ের এমন আচরণের জন্য বাবার কাছে নাকি বিরূপ মন্তব্যও করেছিলেন বড় ভাই দারা। জানা যায়, হীরাবাইয়ের মৃত্যুশোক থেকে বের হতে ঔরঙ্গজেব নিভৃতে শিকারে চলে যান।

বিদ্রোহী রাজ্যে এমন একাকী যাওয়ার ঝুঁকি না নেওয়ার জন্য মীর আসকারি (আকিল খান)-র সাবধানবাণী শুনে ঔরঙ্গজেব বলেছিলেন, ‘’ঘরের বিলাপ হৃদয়কে মুক্তি দিতে পারে না, একাকীত্বের মধ্যে আপনি আপনার হৃদয়ের দুঃখে কাঁদতে পারেন।‘’ ঔরঙ্গজেবের এই কথাতেই পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর শোকাতুর হৃদয়ের। প্রণয়িনীর চিরবিচ্ছেদের শোক কাটিয়ে উঠতে জীবনের ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত পরবর্তীকালের মোগল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে কালো অধ্যায়ের রচয়িতা ঔরঙ্গজেব।