ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের ২০ বছর পরও স্মৃতির পাতায় তাজা সেই দিন

ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের ২০ বছর

ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের ২০ বছর দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে । গোটা বিশ্ব সেদিন দেখেছিল আকাশ ছোঁয়া দুটো বাড়ির হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ার ছবি। তার সঙ্গে তার তলায় জীবিত সমাধী হয়েছিল কত মানুষের। আমেরিকায় বসে সেই দিনের অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতার কথা লিখলেন পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়।


আমি তখন নিউ জার্সিতে মেডিক্যাল রাইটার হিসেবে কাজ করতাম পারসিপেনি বলে একটা জায়গায়। ২০০০ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্নালিজম পাশ করে বেরনোর পর সেই ৪০ বছর বয়েসে কে আমাকে আর হঠাৎ কাজ দেবে? তাই পুরনো সায়েন্সের ডিগ্রি আর লেখার দক্ষতার উপর ভিত্তি করেই কাজ খুঁজে নিতে হল। নিউ ইয়র্ক শহরে ভদ্র ভাবে পরিবার নিয়ে বাঁচতে গেলে ভাল কাজ অত্যন্ত জরুরি।

সকাল ৭টায় গাড়ি নিয়ে ব্রুকলিন থেকে বেরিয়ে যেতাম। ঘণ্টা দেড়েক গাড়ি চালিয়ে সাড়ে আটটায় অফিস পৌঁছতাম। আমার স্ত্রী সেই সময় বাড়িতেই থাকতেন। অলব্যানি থেকে নিউ ইয়র্কে আসার পর নতুন শহরে নতুন কাজ খুঁজে নিতে একটু সময় লেগেছিল। সেই সময়ে আমাদের মেয়ে যাতে এই কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি ভাল কোনও হাইস্কুলে ভর্তি হতে পারে, তার জন্যে ওর সঙ্গে ঘরে থাকার প্রয়োজন ছিল। নিউ ইয়র্কে যেমন ভাল ভাল স্কুল আছে, তেমনই আবার একেবারে শোচনীয়, বিপর্যস্ত অবস্থার স্কুলও অনেক আছে। তার সংখ্যাই বেশি। ঠিক মতো পরিবেশে মানুষ না করা এবং ভাল স্কুলে না যেতে পারা মানে কিন্তু নিউ ইয়র্কে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমাদের মেয়ে প্রতিযোগিতামূলক একটা ভর্তির পরীক্ষা দিয়ে নিউ ইয়র্ক শহরের নাম করা সরকারি স্কুল স্টাইভেসেন্টে ভর্তি হয়ে আমাদের নিশ্চিন্ত করেছিল যদিও।

১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। মঙ্গলবার।

ঠিক আগের সপ্তাহে নতুন স্কুলবর্ষ শুরু হয়েছে। আমি প্রথম দু’এক দিন মেয়ের সঙ্গে সাবওয়ে করে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসেছি। বোধহয় আগের সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার। তার পর সোমবার সে নিজেই গিয়েছে স্কুলে। মঙ্গলবারও। আমি সকালে গাড়ি চালিয়ে চলে গিয়েছি নিউ জার্সি। ৯টার একটু পরেই আমাদের কাজের জায়গায় একটি মেয়ে বলল, ‘‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উপরে নাকি একটা প্লেন আক্রমণ করেছে। এখনও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না আসল ব্যাপারটা কী!’’ টিভিতে কিছু দেখাচ্ছে না। আরও ১৫-২০ মিনিট পরে আসল ব্যাপারটা জানা গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতচকিত হয়ে পড়লাম।

ধ্বংসের আগের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার

এ কী ব্যাপার! তার পর শুরু হল টিভিতে এক টানা ঘটনার বর্ণনা। টিভি স্ক্রিনে নীচের দিকে ধারাবাহিক বর্ণনা স্ক্রোল করে যেতে লাগল। একটু পরেই এক এক করে দুটো টাওয়ার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। অবিশ্বাস্য ধুলোর ঝড়। একটানা অ্যাম্বুল্যান্স, পুলিশের নানা রকম গাড়ি এবং ফায়ার ইঞ্জিনের নিরবচ্ছিন্ন সাইরেন। ঘটনার বীভৎসতায় আমরা সবাই স্তম্ভিত!

প্রথমেই যেটা মনে হল, মেয়ে কোথায় গেল? সে নিরাপদে আছে তো? কিন্তু তা জানার আর কোনও উপায় নেই। সেল ফোন কাজ করছে না। টিভিও মাঝে মাঝেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার পর আবার চালু হলেও স্টাইভেসেন্ট হাই স্কুল সম্পর্কে কোনও খবর আমরা পাচ্ছি না। বাড়িতে বার বার ফোন করে খোঁজ নিচ্ছি আমার স্ত্রীর কাছে। সে-ও উৎকণ্ঠা, উদ্বেগে আকুল। মেয়ের নতুন বন্ধুদের দু’এক জনের বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল গত কয়েক মাস ব্রুকলিন অঞ্চলে থাকা এবং ক্লাস এইটে শেষের কয়েকটা মাস পড়ার সুবাদে নতুন শহরের সঙ্গে একটু পরিচিতি। আমরা সেই অভিভাবকদের ফোন করছি। তারাও কিছু জানেন না। এ ভাবে কেটে গেল দুপুর ১২টা, সাড়ে ১২টা পর্যন্ত।

আমি এর মধ্যে আমার পুরনো দু’এক জন সহকর্মী— যাঁরা ম্যানহ্যাটানে কাজ করতেন— তাঁদের ইমেল করেছি। কার্ট এপস্টাইন বলে আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী ছিলেন, তাঁকে লিখলাম, “ব্রাদার কার্ট, তুমি একটু খোঁজ নেবে স্টাইভেসেন্টের কী অবস্থা? ওখানকার ছেলে-মেয়েরা কেমন আছে? আমার মেয়েও ওখানে আটকে গেছে মনে হয়। তুমি একটু দেখবে?”

কার্ট চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওকে পুলিশ ওই এলাকায় ঢুকতে দেয়নি। কাউকেই ঢুকতে দিচ্ছিল না। সে জায়গা তত ক্ষণে একেবারেই যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছে। ধোঁয়া এবং ধুলোর ঝড়। মানুষ দিশেহারা হয়ে, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পালাচ্ছে। চতুর্দিকে বিষ বিষ একটা গন্ধ। বাতাসে হাজার বিষাক্ত, ভয়ঙ্কর রাসায়নিক পদার্থ ভেসে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যেই পুলিশ, মিলিটারি, ফায়ারফাইটাররা, মেডিক্যাল কর্মীরা এবং অগণিত স্বেচ্ছাসেবক দৌড়োদৌড়ি করছেন। মৃতদেহ বয়ে বয়ে নিয়ে আসছেন অনেকে।

আহত অসংখ্য। মুখ থেকে পা পর্যন্ত ছাইয়ে ঢাকা পুরুষ ও নারীর দল ছুটোছুটি করছে। কেউ কেউ চিৎকার করে কাঁদছে। কেউ কেউ অভিশাপ দিচ্ছেন। আর কেউ বা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছেন। এ সব অবশ্য আমি নিজের চোখে দেখিনি। কার্ট কিছুটা বলেছিল। আর বাকিটা শুনেছি আমার মেয়ের কাছে। অনেক পরে।

মেয়ে নিজের চোখে তার ৯তলার কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি থেকে দেখেছিল, অসহায় মানুষ সব ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের একেবারে উপর থেকে লাফিয়ে পড়ছে। সে সব দৃশ্য দেখে তার কয়েক জন বান্ধবী ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়েছিল। কয়েক জন স্কুল ছেড়ে দিয়ে চলেও গিয়েছিল পরে।

প্রথম টাওয়ার আক্রান্ত হওয়ার প্রায় ৫ ঘণ্টা পরে আমরা প্রথম টিভিতে খবর পেলাম, স্টাইভেসেন্টের ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারা সকলে নিরাপদে আছেন। কিন্তু আমার মেয়ে ও তার বন্ধুদের কাছে আমরা জেনেছি, এত বড় স্কুলের প্রায় ১২০০ ছাত্রছাত্রীকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনও সরকারি ব্যবস্থা ছিল না। কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বলতে গেলে, তাদের কথা তেমন করে ভাবেইনি। সেই সময়ে ওদের স্কুলে ট্রিয়াজ সেন্টার করা হয়েছে। অর্থাৎ, আহত ও পঙ্গু মানুষদের নিয়ে এসে সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্কুলের স্টুডেন্টদের বলে দেওয়া হয়, তোমরা দল বেঁধে উত্তর দিকে হাঁটতে থাক। অর্থাৎ, সামনেই ঘটতে থাকা নারকীয় অবস্থা থেকে যতটা সম্ভব দূরে চলে যাওয়া যায়। ব্যস, এই পর্যন্ত।

এ সব ঘটনা আমরা পরে জেনেছি।

রাত ১০টার কিছু পরে আপাদমস্তক ধুলোমাখা মেয়ে তার বন্ধুদের সঙ্গে পাঁচ মাইল হেঁটে, কিছুটা এক বান্ধবীর মায়ের গাড়িতে, হেঁটে ব্রুকলিন ব্রিজ পার হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল তার মায়ের কাছে।

আমি সে দিন নিউ জার্সি থেকে বাড়ি ফিরতেই পারিনি।

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)