১৬ অগস্ট ১৯৮০ ইডেনে ছিলাম, সে দিন লাশের পর লাশ বার হতে দেখেছি

১৬ অগস্ট ১৯৮০ ইডেনেসে দিনের ইডেন। ইনসেটে লেখক।

১৬ অগস্ট ১৯৮০ ইডেনে আগুন জ্বলেছিল। ১৬ জন সমর্থকের মৃত্যু হয়েছিল পদপৃষ্ঠ হয়ে। সেদিনের সেই স্মৃতি আজও সেই সময়ের মানুষের মনে তাজা। ভাবলে আজও আতঙ্কের বলিরেখা ফুটে ওঠে তাঁদের মুখে। মনে পড়ে যায় মাঠ থেকে স্ট্রেচারে করে বেরিয়ে আসা একের পর এক নিথর দেহ। কে দায়ী সেদিনের সেই ঘটনার জন্য? শুধুই কি দিলীপ পালিত আর বিদেশ বসুর মাঠের মধ্যের ঝামেলা নাকি অন্য কিছু? জাস্ট দুনিয়ার জন্য লিখলেন সেদিন ইডেনে হাজির থাকা ফুটবল ফ্যান সাত্যকি রায়


দিনটা আজও মনে আছে। আমৃত্যু মনে থাকবে। ১৫ বছর বয়স। ক্লাস টেনে পড়ি। জীবনে অতগুলো লাশ একসঙ্গে দেখার স্মৃতি কি কখনও মুছতে পারে! তখন তো আর বুঝিনি ওঁরা সবাই মারা গেছে‌ন। পরে জেনেছিলাম। তখন তো ভেবেছি, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন, তাই স্ট্রেচারে করে বার করছে। হাসপাতালে নিয়ে যাবে! বাড়ি ফিরে জেনেছিলাম, কী ভয়ঙ্কর কাণ্ডটাই না ঘটে গিয়েছে। রেডিও-তে তত ক্ষণে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছে, ইডেনে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে ১৬ জন মারা গিয়েছেন! আজও ভাবলে মনটা কেমন অবশ হয়ে যায়। আর রাগ হয় আইএফএ-র উপর।

আমার এক দাদার সঙ্গে সে দিন ইডেনে গিয়েছিলাম। ভরা মাঠ। প্রচণ্ড উত্তেজনা ছিল। প্রথম থেকেই। আমরা বসেছিলাম এল ব্লকে। ওটা ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের মেম্বার স্ট্যান্ড ছিল। মোহনবাগানের জন্য ছিল বি ব্লক। ক্লাব হাউসের ডান দিকে। আর ঘটনাটা হয়েছিল রঞ্জি স্ট্যান্ডে। যেটা এখন ডি ব্লক। তখন ওটাই একমাত্র কংক্রিটের স্ট্যান্ড ছিল। যে সমর্থকেরা ৯০ পয়সা এবং ১টাকা ১০ পয়সা দিয়ে টিকিট কেটেছিল, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের সেই সাধারণ সমর্থকদের ওখানে পাশাপাশি বসার ব্যবস্থা করেছিল। এটাই অন্যতম ভুল। ওই দিন ওখানে ও ভাবে বসার ব্যবস্থা না করলে হয়তো এমন কিছুই হত না।

প্রথম থেকেই আবহাওয়া গরম ছিল। খেলা শুরুর আগে থেকেই একটা অস্থির পরিস্থিতি। অনেকে বলেন, দিলীপ পালিত আর বিদেশ বসুর গন্ডগোলের কারণেই পরিস্থিতি হিংসাত্মক চেহারা নেয়। ৪১ বছর আগেকার ওই ঘটনার এক জন প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে বলতে পারি, হিংসা কিন্তু দিলীপ-বিদেশের গন্ডগোলের অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। সেটাই এ বার বলছি। ওই রঞ্জি স্ট্যান্ডে বেশ কিছু পিলার ছিল। ক্রিকেট খেলা দেখার সময় ওই পিলারগুলিতে চাঁদোয়া টানানো হত। ওই দিন দু’দলের ফুটবল সমর্থকেরা কে কোথায় পতাকা লাগাবে, তা নিয়েই প্রথমে গন্ডগোল শুরু হয়।

স্পষ্ট মনে আছে, প্রথমে একদল ইস্টবেঙ্গল সমর্থক ওই পিলারে নিজেদের পতাকা লাগান। কিন্তু মোহনবাগানের সমর্থকেরা এসে আপত্তি করেন। পতাকায় আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেই থেকে গন্ডগোলটা ধিকি ধিকি জ্বলছিলই। তার পর সেই ধিকি ধিকি আগুনে বড়সড় একটা ফুঁ দিল— দিলীপ আর বিদেশের ট্যাকল। আসলে সপাটে একটা লাথি। পিছনে। বিদেশের পিছনে। তার পর আগুনটা পূর্ণ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে।

আমরা তো উল্টো দিকে বসে ছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম, ভয়ঙ্কর মারামারি শুরু হয়ে গিয়েছে। পতাকা টানানোর জন্য যে সব বাঁস নিয়ে আসা হয়েছিল, তা দিয়েই ভয়ঙ্কর মারামারি। কিছু মানুষ তাড়াহুড়ো করে বেরতে গিয়ে একেবারে পদপিষ্ট। গ্যালারির উপরের ব্লক থেকে আমি নীচে লোকজন পড়তেও দেখেছি। কিন্তু অত লোক যে মারা গিয়েছেন, সেটা মাঠে বসে বুঝতেই পারিনি। অনেককে মাঠের ভিতর দিয়ে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। অতটা দূর থেকে সবটা বোঝার মতো অবস্থাও ছিল না। আমরা ভেবেছি, মারামারিতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।

ক্লাব হাউস থেকে কারা যেন চিৎকার করে বলছিল, অনেকে মারা গেছে। আমরা শুনছিলাম। কিন্তু ভাবতে পারিনি, এত লোক মারা যাবে! সে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। আমরা মাঠ থেকে বেরতেও পারছি না। ভয়ে একেবারে কোণার দিক করে বসে আছি। দাদার হাতটা ধরে। বাইরে অর্থাৎ ইডেনের বাইরে তখন রণক্ষেত্র। মারামারিও হচ্ছে। পুলিশ প্রচণ্ড লাঠিচার্জ করেছে। আমরা ঝাড়া এক ঘণ্টা মাঠের ভিতরে বসে। খেলা তো সেই তখনই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। স্টেডিয়াম জুড়ে শুধু মারামারি হচ্ছে। পতাকায় আগুন। বাঁশ দিয়ে মারধর। ইট ছোড়া। উফস! ভাবলেই কেমন যেন হয় আজও।

ঘণ্টাখানেক পরে সেই দাদার হাত ধরে ইডেন থেকে বেরিয়ে সোজা রেড রোড ধরে দৌড় লাগালাম, মেয়ো রোডের দিকে। ওখান থেকে ট্রাম ধরব। বাড়ি টালিগঞ্জে। তখন তো বাচ্চা ছিলাম। পয়সাকড়িও নেই। তাই ট্রামে করেই ময়দানে আসতাম। খুব কম বয়স থেকে খেলা দেখতে আসতাম ময়দানে। স্কুলে পড়ি। তবে বাড়ি থেকে ছাড়ত। এর আগেও ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ দেখেছি। সে বছর ফেড কাপের ফাইনালও দেখেছিলাম। মাঠে যাওয়াটা খুব চাপের ব্যাপার ছিল না। পরেও অনেক ম্যাচ দেখেছি ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের। কিন্তু ও রকম হিংসাত্মক মাঠ আমি আগে বা পরে কখনও কোনও দিন দেখিনি।

যাই হোক, তখনও জানি না ১৬ জন মারা গেছেন! তত ক্ষণে রেডিও-তে বলে দিয়েছে। বাবা-মা কোথাও একটা বেরিয়েছিলেন। তাঁরা তো দৌড়ে বাড়ি চলে এলেন। আমরা তত ক্ষণে বাড়ি ফিরেছি। পাড়া থেকে আমি আর ওই দাদা— দু’জনেই গেছিলাম। সবাই এসে খবর নিয়েছিল। তখন তো আর মোবাইল ছিল না। পাড়ার অনেক বন্ধু, দাদা, কাকা আমাদের দেখতে এসেছিল। বেঁচে ফিরে এসেছি বলে।

আজও আমার মাথায় ঢোকে না, কী ভাবে দু’পক্ষের একসঙ্গে বসার টিকিট দেওয়া হয়েছিল! মনে রাখতে হবে, তখনকার ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান এখনকার মতো ছিল না। ও সময়কার পরিস্থিতিতে কী করে এমন ব্যবস্থা করল! তখন কারা আইএফএ-র মাথায় ছিলেন, আজ আর মনে নেই। তবে যাঁরাই ছিলেন, তাঁরা যে অত্যন্ত অবিবেচকের মতো কাজ করেছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

(এখানে সম্পূর্ণ মতামত লেখকের, সেটাই তুলে ধরল জাস্ট দুনিয়া)

(লেখক পেশায় ট্রাভেল এজেন্ট। টালিগঞ্জের জুবিলি পার্কের বাসিন্দা)


প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)