১৬ অগস্ট ১৯৮০, ফুটবল বিশ্বের এক বেদনাদায়ক দিন, কলঙ্কিতও বটে

১৬ অগস্ট ১৯৮০ছবি-সংগৃহিত

১৬ অগস্ট ১৯৮০ বাংলা তো বটেই গোটা ভারত, মনে হয় গোটা ফুটবল বিশ্বের একটা বেদনাদায়ক দিন, কলঙ্কিতও বটে। ৪১ বছর আগের ১৬ অগস্ট কী হয়েছিল? সে দিন প্রেসবক্সে বসে চোখের সামনে দেখেছিলেন উত্তেজনায় ফেটে পড়া গ্যালারির দৃশ্য। তাঁর কলমেই ফিরে দেখা যন্ত্রণার সেই ইতিহাসকে। লিখলেন সাংবাদিক বিপ্লব দাশগুপ্ত


আজও সেই দিনটি চোখ বুজলেই দেখতে পাই। মনে পড়লেই আঁতকে উঠি। ভয়ঙ্কর দিনের সাক্ষী হয়ে বয়ে চলেছি ক্ষত। প্রেসবক্স থেকে ঘটনার ভয়াবহতা টেরই পাইনি সেই সময়। শুধু দেখেছিলাম ইস্টবেঙ্গল গ্যালারি থেকে বৃষ্টির মতো ইট গিয়ে পড়ছে মোহনবাগান গ্যালারিতে। ইডেন থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে ইস্টবেঙ্গল টেন্টে পৌঁছেছিলাম। ওই টেন্টে গিয়ে দেখলাম উত্তেজনা রয়েছে। সেখানে গিয়ে একটা আঁচ পাই ঠিকই, কিন্তু তখনও সঠিক খবর এসে পৌঁছয়নি। সেই সময় এত দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ত না। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল, বেশ কয়েক জন গুরুতর আহত। মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে জানা যায়নি তখনও। বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিই। সঙ্গে তখন দিলীপ পালিত। ওর সঙ্গে গাড়িতে বাড়ি ফিরেছিলাম। তখন ও টালা পার্কে থাকত। ওখানে পৌঁছে দেখি থমথমে দিলীপের পাড়া। জানতে পারলাম, রেডিওতে বলেছে, ইডেনে আজ ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। সেই সময় দিলীপকে ভেঙে পড়তে দেখেছিলাম চোখের সামনে। পর দিন যুগান্তর পত্রিকায় হেডিং ছিল, ‘কাঁদো কলকাতা কাঁদো’।

১৬ অগস্ট ১৯৮০, ইডেন উদ্যানে কলকাতা লিগের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল দুই বড় দল মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল। সেই বছরই ৯ মে এই দু’দল মুখোমুখি হয়েছিল ওই ইডেন উদ্যানেই ফেডারেশন কাপের ফাইনালে। ম্যাচটা ১-১ গোলে অমিমাংসিত অবস্থায় শেষ হয়েছিল। সেদিন এই বড় ম্যাচকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা তো ছিলই এবং কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছিল। যা দেখে স্তম্ভিত হয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। কিছুটা বিরক্তির সুরেই বলেছিলেন ‘‘আমি আর এই দুই বড় দলের খেলা দেখতে আসব না।’’ পর দিন আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রদ্ধেয় মতি নন্দীর কলমেও তা প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘এমন ২৫-এ বৈশাখ আর যেন কখনও ফিরে না আসে।’’ ৯ মে ছিল ২৫ বৈশাখ।

যে ১৬ জন ফুটবলপ্রেমী সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন

কার্তিক মাইতি, উত্তম চৌলে, সমীর দাস, অলোক দাস, সনৎ বসু, নবীন নষ্কর, কল্যান সামন্ত, অসীম চট্টোপাধ্যায়, রবীন আদক, কার্তিক মাঝি, ধনঞ্জয় দাস, শ্যামল বিশ্বাস, মদন মোহন বাগলি, প্রশান্ত দত্ত, হিমাংশু শেখর দাস, বিশ্বজিৎ কর।

আসলে ১৯৮০-তে কলকাতা ফুটবলকে ঘিরে একটা উত্তেজনার বাতাবরণ তৈরি ছিলই। অনেক দিন পর মহমেডান শক্তিশালী দল গড়েছিল। কাগজেকলমে সেরা ছিল মোহনবাগান। আর জামশেদ নাসিরি ও মজিদ বাসকরের আগমনে দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছিল ইস্টবেঙ্গলও। সে দিনটা ছিল শনিবার। সকাল থেকেই কলকাতা, শহরতলি, মফস্‌সল চলে গিয়েছিল ফুটবলপ্রেমীদের দখলে। বাঙালি দুটো দিকে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। প্রবল উত্তেজনার মধ্যে শুরু হয় দুই বড় দলের লড়াই। খেলা শুরুর আগে দু’দলের ফুটবলারদের ডেকে রেফারি সুধীন চট্টোপাধ্যায় বলে দিয়েছিলেন, কোনও রকম উত্তেজনার পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়।

খেলা শুরু হল। বলতে দ্বিধা নেই, সামগ্রিক বিচারে একটু এগিয়ে ছিল সে দিন মোহনবাগানই। দ্বিতীয়ার্ধ সবে শুরু হয়েছিল। এ রকমই একটি আক্রমণ বাঁ দিক থেকে শুরু করেছিল মোহনবাগান। সেই ম্যাচেই দিলীপ পালিতকে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে নিয়ে গিয়ে ব্যবহার করেছিলেন কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদেশ সে বার দুরন্ত ফর্মে। তাঁকে রোখার দায়িত্ব ছিল দিলীপের উপর। দিলীপের কড়া ট্যাকলে ছিটকে গেলেন বিদেশ। সঙ্গে সঙ্গে রিঅ্যাক্ট করেছিলেন বিদেশ। উঠে সপাটে লাথি মেরেছিলেন দিলীপকে। রেফারি দু’জনকেই লাল কার্ড দেখান।

এতেই ক্ষেপে ওঠে ইডেন উদ্যান। মাঠের উত্তেজনা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে গ্যালারিতে। মোহনবাগান গ্যালারির দিকে লক্ষ্য করে ইডেন উদ্যানের উপর তলা থেকে ইট বৃষ্টি শুরু করে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা। তাতে প্রাণ ভয়ে পালাচ্ছিলেন মোহনবাগান সমর্থকরা। সেই সময় উত্তেজনার বশে অনেকেই টাল সামলাতে পারেননি। পড়ে যান, তাঁদের উপর দিয়েই চলে যায় মানুষ। পদপিষ্ট হয়ে ১৬ অগস্ট ১৯৮০-তে মৃত্যু হয় ১৬ জনের। যদিও লাল কার্ড দেখানোর পর মাঠ লক্ষ্য করে প্রথমে ইট পাটকেল ছুড়েছিল মোহনবাগান সমর্থকরা। তবে তা ছিল সামান্যই। আর সেটাই ক্রমশ ভয়ঙ্কর আকার নেয়। এত মৃত্যু ভারতীয় ফুটবল দেখেনি, দেখেনি এত রক্ত। সেই কঠিন ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও বেঁচে রয়েছি আমরা।

শোনা যায়, ইডেনের সেই গেটের চাবি সে মুহূর্তে পাওয়া যায়নি। চাবি খুঁজে এনে সেই গ্যালারির দিকের গেট খুলতে দেরি হয়েছিল তাই এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। খেলার পর খবরটা যখন শুনলেন তখন দু’দলের ফুটবলাররা বিশেষ করে দিলীপ পালিত এবং বিদেশ বসু নিজেদেরই অপরাধী ম‌নে করে ভেঙে পড়েছিলেন। কলকাতা লিগ সেবার পণ্ডই হয়ে গেল। তার পরও খেলার মাঠে রক্তপাত হয়েছে তবে এই মৃত্যু মেনে নিতে পারিনি আজও। ১৯৮১ থেকে এই দিনটিকে কেন্দ্র করে পালন হয় ফুটবলপ্রেমী দিবস। ইডেনে হয় রক্তদান শিবির। সে দিন যাঁরা মাঠে গিয়েছিলেন বা যাঁরা খেলেছিলেন তাঁরা আজও এ দিনটায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেন।

সেদিনের ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের প্রথম একাদশ

ইস্টবেঙ্গল: দিলীপ পাল, দিলীপ পালিত, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সত্যজিৎ মিত্র (অধিনায়ক), মাহমুদ খাবাজি, সুধীর কর্মকার, মহম্মদ হাবিব, সমর ভট্টাচার্য, তপন দাস, জামশিদ নাসিরি, মজিদ বাসকর।
(ইস্টবেঙ্গলে পরিবর্ত হিসেবে নেমেছিলেন হরজিন্দর সিং এবং কাজল চট্টোপাধ্যায়।)
কোচ: প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
মোহনবাগান: শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়, কম্পটন দত্ত (অধিনায়ক), প্রদীপ চৌধুরী, সুব্রত ভট্টাচার্য, শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম সরকার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, মানস ভট্টাচার্য, জেভিয়ার পায়াস, মিহির বোস, বিদেশ বসু।
(মোহনবাগানে পরিবর্ত হিসেবে নেমেছিলেন উলগানাথন)
কোচ: অমল দত্ত
(রেফারি সুধীন চট্টোপাধ্যায়)

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)