অনিলের জলসাঘর

ঠান্ডার ছেঁকাটা গায়ে লাগছে। আজ এ চত্বরে বেশ হাওয়া। পৌষ সংক্রান্তি বলে কথা!
তবু থেমে নেই ঠোঁট। অনবরত সে ফুঁ দিয়ে চলেছে সুরের ঝাঁকিতে। আর নাগরিক মিছিলে ছড়িয়ে পড়ছে রাগের মায়া। ভিড়ের গায়ে একটু একটু করে লেগে যাচ্ছে সেই সুর। ঠিক যেমন করে মিহি তুষার লেগে যায় পাহাড়ি শরীরে!
না এ কোনও পাহাড় নয়। এ তো নিতান্ত কেজো এক শহর। আর সেই বিরামহীন শহরেই অনিলবাবু নির্মাণ করেছেন তাঁর সুরের রাজধানী। সুরতোলা সাঁজোয়া গাড়ি চেপেই রাজধানীর এ পার থেকে ও পার, পূর্ব থেকে পশ্চিম বিহার করে বেড়ান বর্ধমানের ‘কিশোর’। নগরকীর্তনে বেরিয়ে কখনও ধর্মতলার মোড়, কখনও বা দমদম মেট্রো স্টেশন, জাদুঘর বা ময়দানি সাম্রাজ্য— হেঁটে বেড়ায় সুরের পালকি।
বাঁ কাধে ঝোলানো তাঁর দরবারঘর। সেখানেই সব— মন্ত্রী, সেনাপতি, উজির, আমির, ওমরাহ। এক এক করে সকলেই নিজের নিজের কেরামতি শোনায়। অনিলবাবু সম্রাট। ফুঁ দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করেন গোটা সাম্রাজ্য। রাজার পরনে ফিকে হয়ে আসা পাঞ্জাবি। ঢোলা পাজামাটার রংও কোনও এক কালে সাদা ছিল। কিন্তু তাতে কি! সাম্রাজ্য চালাতে কোনও অসুবিধা হয় না। আসলে সম্রাটই তো দরবার হল নিয়ে হাজির হন প্রজার কাছে। প্রজাদের ভিড়ে মিশিয়ে দেন সরগম।
কোনও এক কালে অনিলবাবু থাকতেন বর্ধমানের মেমারিতে। শৈশব পেরিয়ে কৈশোর— সেই ‘মেমারি’ নিয়েই তিনি হাজির হলেন সোজা এই মহানগরে। বইপাড়া কলেজস্ট্রিটেই এক চিলতে ঠাঁই। যাত্রাগানের দলে থাকা অনিলের যে সুর-শিক্ষে হয়েছিল— তা ভাঙিয়েই চলতে থাকল একের পর এক রাজ্য জয়। তার পর একটা গোটা সাম্রাজ্যের মালিকানা জুটেছে। সে সাম্রাজ্যে মহা খুশিতেই কাটে অনিলের সুর-সংসার।
ঠান্ডা বলে পাতলা একটা চাদর গায়ে সম্রাটের। স্টিলের গেলাসটা সঙ্গে নিয়েই ঘোরেন। ওটাই তো তাঁর চা-পেয়ালা। সঙ্গে মোড়ক করা বিস্কুট। সারা দিন ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে মাঝে মাঝেই চলে ধূমপান। সম্রাটের উত্থানের সিঁড়ি কিন্তু ‘বিড়ি’র হাত ধরেই। তবে নিয়মিত ধূমপান শৈশব-কৈশোর-যৌবন পেরিয়ে আসা এই প্রৌঢ়ের শ্বাসের দমক কিন্তু কমাতে পারেনি একফোঁটাও।
দিনের বেলা গোটা ধর্মতলা-নিউমার্কেট চত্বর পেরিয়ে বিকেল থেকে জলসাঘর বসে এই দমদম চত্বরে। মেট্রোর বাইরেটাতেই দরবার সাজান অনিলবাবু। পেশা যদিও বাঁশি বিক্রি। কিন্তু, দিনের শেষে ক’টা বাঁশি যে বিক্রি হয়, তা নিভৃত প্রাণের দেবতাই জানেন হয়তো। আসলে সুর শুনিয়েই মজা পান তিনি। ঘরফিরতি মানুষ তাঁর সুরের মিহি কণা গায়ে মেখে নেয়। অনেকেই মূর্চ্ছনায় আপ্লুত। কেউ কিনে নেন অনিলের কোনও উজিরকে। কখনও সখনও তাঁর মন্ত্রী-সান্ত্রীরাও ভাল দামে বিকিয়ে যায় প্রজার কাছে।
মকর সংক্রান্তির সন্ধ্যায় ঠান্ডা কামড় বসিয়েছে মহানগরীর শরীরে। তাতেও বসেছে এ দিনের জলসাঘর। মেট্রো থেকে বেরিয়েই… অনিলের বাঁশির ঝোলা পাশে নামানো। দু’হাতের আলিঙ্গনে মুড়ে রাখা একটি আড়বাঁশি। আর তাতে বড় যত্নে ফুঁ দিয়ে অতল থেকে সুর তুলে আনছেন অনিল। কুয়াশার হাল্কা প্রলেপ মাখা স্টেশন চত্বরের কোলাহলে তখন আর কোনও আওয়াজ সোনা যায় না। শুধু শোনা যাচ্ছে… রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে, তোমায় আমায় দেখা হল সেই মোহানার ধারে… অনিলের দরবারে আজ এসেছেন তাঁর প্রিয়, বড়ই প্রিয় রবীন্দ্রনাথ।