‘সোনার পাহাড়’, সম্পর্কের টানাপড়েনের কাহিনি ছুঁয়ে যায় মনকে

সোনার পাহাড়

মেঘ চক্রবর্তী


সোনার পাহাড় , এমন সোনার পাহাড়ই তো সবাই চায়। যে সোনার পাহাড় পাপুন চেয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে সেই সোনার পাহাড়ই আজকে চায় বিটলু। বিটলু থাকে অনাথ আশ্রমে। ওর বাবা-মা কেউ নেই। ও এইচআইভি পজেটিভ। তা সে বেশ গর্ব করেই বলে।  আর পাপুন থাকে দক্ষিণ কলকাতার এক বনেদী বাড়িতে। পাপুনের বাবা নেই। মাকে ঘিরেই ওর জীবন। মা-রও তাই। একদিন হঠাৎ সব বদলে যায়। পাপুনের সোনার পাহাড়ের স্বপ্ন ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় বিটলুর কাছে। সেই ফেলে আসা স্বপ্ন নতুন করে দেখতে শুরু করে বিটলুর উমা। যে এতদিন পাপুনের মা হয়ে স্বপ্ন দেখত।

বিটলু, পাপুন, উমার জীবনের না দেখতে পাওয়া সূতোটাকে বেঁধেছেন পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ছবিতেও সেই বুনে চলেছেন সম্পর্কের শীতলপাটি। জীবনের জটিলতা, খিটখিটে শাশুরি, বিয়ের পর বাড়ি ছেড়ে আলিশান ফ্ল্যাটের সংসার। সব বাস্তব জীবনকে ছুঁয়ে যায়। এ ভাবেই জীবনের ছন্দ খুঁজেছে ‘সোনার পাহাড়’। যে সোনার পাহাড়ের সামনেই সব অভিমানের বাধ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। মিলে যায় মা-ছেলে।

টালিগঞ্জে আসছে একদল ভূত!

খিটখিটে বয়স্ক মহিলাই বলুন বা শাশুরির ভূমিকায় তনুজা দারুণ। অনেকদিন পর আবার বাংলা সিনেমায় তনুজাকে এনে চমক দিয়েছেন পরমব্রত। তনুজার অল্প বয়সের চরিত্রে গার্গীও খুব ভাল। পাপুনের ভূমিকায় যীশু সেনগুপ্ত বাস্তব জীবনের মতো সিনেমায়ও রাজের চরিত্রে পরমব্রতর বন্ধু। রাজের উদ্যোগেই আবার মা-ছেলের মিলন। শেষটা গ্যাংটকের পাহাড়ে করার সিদ্ধান্তটা সম্পর্কের টানাপড়েনগুলোকে আরও টানটান করে তুলেছে।

বিটলুর রাজদার এনজিও-তে হঠাৎ তনুজার সঙ্গে দেখা পাড়াতত দাদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি বাচ্চাদের খেলনা দাদু। ছোট্ট একটা চরিত্র। আর সেই চরিত্রই তনুজাকে আবার ফিরিয়ে আনে লেখার জগতে। হারিয়ে যাওয়া লেখা খুঁজে পেতেই কাউকে না বলে বিটলুর হাত ধরে গ্যাংটক পাড়ি দেয় উমা (উপমা, যা ছোট করে বিটলু উমা ডাকে)।

পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে ছেলেকে আবার নতুন করে খুঁজে পায় উপমা। পুত্রবধুর ভূমিকায় অরুনিমা খুব গ্ল্যামারাস। কখনও শাশুরির ব্যবহারে গাড়ি থেকে মাঝ রাস্তায় নেমে যায় আবার কখনও শাশুরিকে মানাতে বড়ের সঙ্গে পাহাড়ে রওনা দেয়। কখনও তাঁর মনে হয় সেই এই সবের জন্য দায়ী। পরমব্রতকে তাই সে জিজ্ঞেস করেই ফেলে, ‘‘আমিই কি দায়ী এই সবের জন্য?’’ এখানেও বড় বাস্তবকে ছুঁয়ে গিয়েছে সোনার পাহাড়। আসলে পরের বাড়ির মেয়েটা দায়ী হয় না বুঝিয়ে দিয়েছেন পরমব্রত। তখনই পাপুনের হাতে আসে মায়ের সেই লেখা। পাতার পর পাতা উড়ে যায় পাহাড়ের খাদে। চোখের জল বাঁধ মানে না। সেই ছোটবেলার পিয়ানো, ঘুড়িরা যেভাবে পাপুনের আঁকার খাতা থেকে বাস্তব রূপ নিত সেভাবেই বাস্তবটাকে বোঝে ছোট্ট পাপুন।

কলকাতার রাস্তা থেকে পাহাড়ি প্রকৃতি দারুণভাবে ধরা দিয়েছে একটা ক্যানভাসে।  পাড়ার রাস্তায় জমে থাকা জলে যেভাবে বোতলবন্দী সোনার পাহাড়ের ম্যাপ পেয়েছিল পাপুন সেভাবেই রাস্তা খুঁজে পায় সম্পর্কগুলো। সোনার পাহাড়ের গল্প লেখাও শেষ হয় উপমার। ছেলেকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে খিটখিটে শাশুরি। বিটলু লুকিয়ে দেখে। এটাই তো তার মিশন ছিল। খেলনা দাদু বলেছিল যে।

চোখে জল আসে। দেখতে দেখতে যেন ডুবে যাই উমা, পাপুন, বিটলুর জগতে। পরমব্রতকে ধন্যবাদ এমন একটা ছবি করার জন্য। বিটলুর ডায়লগ হাসায়। যীশুর ডায়লগ শেষ বেলায় কাঁদিয়ে ছাড়ে। বাস্তবের জমিতে মসৃন গতিতে এগিয়ে চলে সোনার পাহাড়। দিনের শেষে সেই পাহাড়ের গায়ে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে সবার গায়ে উত্তাপ ছড়িয়ে দেয়। দীর্ঘ রেশ থেকে যায় সব কান্না-হাসির।