‘কেদারনাথ’ ধ্বংসাত্মক বাস্তবের আঙিনায় প্রেমের বিনুনী বুনেছেন পরিচালক

কেদারনাথ

সুচন্দ্রা সামন্ত


কেদারনাথের পাহাড়ে রেডিওটা হঠাৎই বেজে ওঠল। জকি বলেন, ‘‘এই গান মুক্কু অনুরোধ করেছে তাঁর মনসুরের জন্য।’’ ছ্যাৎ করে ওঠে বুকটা আবারও। লতাজি গেয়ে ওঠেন ‘‘লগ যা গলে কি ইয়ে হাসি রাত হো না হো।’’ ওদের আর গলে লাগা হল না সারা জীবনের জন্য। তাও মুখে একটা হাসি ছড়িয়ে রেডিওর সামনে বসে থাকে মুক্কু। যেন এখনই কাজ সেরে ক্লান্ত শরীরে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াবে তাঁর প্রেমিক মনসুর। মনসুর আসে না। আসবেও না আর কখনও। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, হাজার হাজার হারিয়ে যাওয়া মানুষের ভিড়ে কত মুক্কু-মনসুর ছিল? প্রেমের কাহিনীকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে কেদারনাথের ধ্বংসের কাহিনী। যার রেশ থেকে যায় অনেকক্ষণ।

পরিচালক অভিষেক কাপুর

অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে পিঠে এক বৃদ্ধাকে চাপিয়ে পাহাড় চড়ছে এক যুবক। পাহাড়ের দু’পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মন্দাকিনি। মাঝখানে স্বপ্নের গ্রাম। যে গ্রামে জন্ম নেয় নতুন আর একটা স্বপ্ন। প্রেমের স্বপ্ন। হিন্দু-মুসলিম প্রেম বাড়তে থাকে সবার অজান্তে। কমতে থাকে বড়লোক-গরীব লোকের দুরত্ব। তখনই একটু একটু করে জানাজানি হয়ে যায় সেই প্রেমের কথা। সিদ্ধান্ত হয় মনসুর (সুশান্ত সিং রাজপুত)দের পুরো দলটাকেই বের করে দেওয়া হবে কেদারনাথ থেকে বাইরে। কারণ সে ছুঁয়ে ফেলেছে এক ব্রাক্ষ্মণ পণ্ডিতের কন্যার মনকে। যে মনসুর কাঁধে করে প্রতিদিন পৌঁছে দেয় কত কত তীর্থ যাত্রীকে মন্দিরের কাছে। সে নাকি মুসলিম তাই তার ঠাই নেই।

চঞ্চল, ক্রিকেটপাগল মন্দাকিনি ওরফে মুক্কু (সারা আলি খান) বুঝতেই পারেননি কখন সেও প্রেমে পড়েছে সেই ঘোরাচালকের। যে কিনা প্রেম প্রেম খেলাতেই বেশি মজে থাকত। সে কথা জানতে পেরে ভেঙে পড়ে মনসুর। কিন্তু পড়ে ভুল ভাঙে তার। কেদারনাথের প্রেক্ষাপটে ধ্বংস এগিয়ে আসার খবর তখনও কারও কাছে নেই। চলতে থাকে প্রেম কেড়ে নেওয়ার লড়াই। দিদির প্রাক্তন প্রেমিকের ইচ্ছেয় তার সঙ্গে জোড় করে বিয়ে হয়ে যায় মুক্কুর। বিয়ে শেষে নিজের হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করে মুক্কু। ক্লাইমেক্সের শুরু এখান থেকেই।

‘ঠগস অব হিন্দোস্তান’এর ব্যর্থতার দায় নিলেন আমির খান

মর্মান্তিক সেই প্রকৃতির ধ্বংসলীলাকে পুরো ছবি ধরে না দেখিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে বেঁধেছেন পরিচালক অভিষেক কাপুর। যে ধ্বংসলীলাকে কেন্দ্র করে মরে গিয়েও বেঁচে থেকেছে একটা প্রেমএর গল্প। শেষটা কিছুটা নাটকীয়। টাইটানিকের কথা মনে পড়ে যায়। তবে সিনেমা তো কল্পনা আর বাস্তবের মিশেলেই একটা সুন্দর রূপ পায়, যা ছুঁয়ে যায় মনকে। রেখে যায় রেশ। কেদারনাথ তেমনই একটা সিনেমা।

হল থেকে বেরিয়েও মুক্কুর জন্য কষ্ট হয়। মাকে ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেমিকার কাছে পৌঁছনোর সেই অদম্য লড়াই মনসুরের। প্রেমিকার বাবা যে একদিন চূড়ান্ত অপমান করে মেয়ের জীবন থেকে তাঁকে বের করে দিয়েছিল সেই পণ্ডিত (নীতিন মুকেশ)কেও জীবন ফিরিয়ে দেয় নায়ক। মা অপেক্ষায় থাকে। কোনও এক ঝর্ণার খাঁজে আটকে থাকা মনুসুরের ফোন বেজে যায়। কেউ ধরে না।

টেকনোলজির সাহায্যে সেই ভয়ঙ্কর বন্যার কয়েক মিনিটের দৃশ্য দম বন্ধ করে দেখতে হয়। তার পর একটা সাময়িক রিলিফ রেখেছেন পরিচালক। এই ছবির মধ্যে দিয়ে মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে চোরাবাড়ি লেকের বাঁধ ভেঙে ভেসে যাওয়া গোটা কেদারনাথের কান্না শোনা যায় এত বছর পরেও। তাণ্ডবলীলা শেষ হলে শুধু বেঁচে থাকে মন্দির। পরের পর বাড়ি ভেঙে পড়ার আসল দৃশ্য দেখা গিয়েছে সিনেমার শেষে। চার হাজারের উপর মৃত। ৭০ হাজারের উপর নিখোঁজ মানুষ আর বাড়ি ফেরেনি। ৫০ হাজারের উপর মানুষকে উদ্ধার করেছিল সেনাবাহিনী। সিনেমার শেষে বাস্তব নথিও উঠে এসেছে দর্শকদের সামনে।

কেদারনাথের প্রকৃতিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন সিনোমাটোগ্রাফার তুষার কান্তি রায়। তার মধ্যেই পরিচালক তুলে এনেছেন একটা জ্বলন্ত ইস্যু। যখন দেখানো হচ্ছে কেদারনাথে টু’স্টার হোটেল, দোকান, আরও কিছু করতে চেয়েছে কোনও এক সংস্থা। যেখানে বাধা দিচ্ছেন স্বয়ং নায়ক। প্রকৃতির ক্ষতি হবে ভেবে। কিন্তু সমাজের উঁচু তলার মানুষরা টাকার লোভে সেটাকেই আহ্বান জানাচ্ছেন। এভাবেই যে একটু একটু করে প্রকৃতিতে রুষ্ট করে চলেছে মানুষ। তার সব থেকে বড় উদাহরণ কেদারনাথ। এই ইস্যু তোলার জন্য পরিচালককে ধন্যবাদ।

একটা জিনিস ভুল করে গিয়েছেন পরিচালক।  বাস্তবকে ধরতে চেষ্টা করেছেন একটাপ্রেম কাহিনীর মধ্যে দিয়ে। কিন্তু আসল প্রেক্ষাপট যখন কেদারনাথের সেই বিধ্বংসী বন্যা তখন বৃষ্টিকে আরও একটু গুরুত্ব দিতে হত পরিচালকের। বাস্তব বলছে সেই সময় টানা বৃষ্টি চলছিল কেদারনাথে।  কিন্তু তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন ঝা চকচকে আবহাওয়া। শেষে এসে কিছুটা বৃষ্টি যখন কেদারনাথ ছাড়ছেন নায়ক। মাঝে একবার প্রেমের দৃশ্য তৈরি করতে বৃষ্টির সাহায্য নিয়েছেন পরিচালক। কিন্তু বৃষ্টি গুরুত্ব পায়নি। বরং পরিষ্কার আকাশ, তুষার শৃঙ্গ, রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন চোখকে শান্তি দিয়েছে বাস্তবকে কিছুটা অগ্রাহ্য করেই। শেষে যে আবহাওয়া অফিসের তৎপড়তা সেটা একটু বেশি গুরুত্ব পেলে বাস্তবতা আরও একটু বাড়ত।

সব মিলে অনেক দিন পর সত্য ঘটনার প্রেক্ষাপটে যে ধ্বংসের মধ্যেও প্রেমের বিনুনী বুনেছেন পরিচালক তা প্রশংসার যোগ্য। এই ছবি সবার দেখা উচিত। শেষে কিন্তু মন খারাপ নিয়েই বাড়ি ফিরতে হবে সবাইকে। আর কেদারনাথ বেড়াতে গেলে এই ছবি আপনার মনে পড়বেই। এটাই হয়তো সাফল্য পরিচালকের, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের। আলাদা করে কারও কথা বলার জায়গা নেই। শুধু এটা বলা যেতে পারে প্রথম ছবি হিসেবে সারা আলি খান অনেকবেশি পরিণত।