রাত জাগা তারা: শীতের ভোরকে বরণ করে উৎসবের আবাহন কলকাতায়

রাত জাগা তারারাত জাগা তারা

মেঘ চক্রবর্তী


উত্তুরে হাওয়ার সঙ্গে শহরে শীতের প্রলেপ পড়ে। ঠান্ডা মাখা সেই শহরে এর পর জমে ওঠে নানা কিছু। কমলালেবু থেকে মোয়া, চিড়িয়াখানা থেকে সার্কাস, ভিক্টোরিয়া থেকে পার্ক স্ট্রিট— পরিপাটি কেকের উপর এক একটা সুদৃশ্য টপিন। সব মিলিয়ে মজে ওঠে আমাদের উৎসবের শহর।

বছর শেষের এই ক’টা দিন বাঙালি উৎসবে মেতে উঠে তালমিলিয়ে পাল্লা দেয় বিদেশের অন্য শহরের সঙ্গে। কিন্তু, বাঙালি তো বাঙালি-ই। তাকে টেক্কা দেয় কে! উৎসব শুরুর আবহটা তাই সে বেঁধে ফেলল ক্রিসমাসের চতুর্থীতে। নিউ ইয়ারের বেশ খানিকটা আগেই। কল্পনাপ্রেমী বাঙালি পূর্ণিমা-রাতকে বেছে নিয়ে করল উৎসবের বোধন।

রবীন্দ্র সরোবরের জলে তখন রুপোলি চাঁদের গোলক নেমে এসে ভাসছে তির তির করে। কুয়াশার পাতলা সরটা একটু সরিয়ে দিলেই স্পষ্ট হয় নজরুল মঞ্চ। সেখানে তখন কবিতা পড়ছেন শ্রীজাত— ‘মুঠোয় বন্দি কফির একলা কাপ, ডিপ্রেশনের বাংলা জানি, মন খারাপ’। রাত ১০টার সময় মঞ্চের নরম আলোয় কবির পঙ্‌ক্তির মাঝে মাঝেই দরাজ গলায় সুর খেলাচ্ছেন শ্রীকান্ত আচার্য, ‘এই রাত তোমার, আমার…’। ব্যাক ড্রপে ফুল স্ক্রিনে নীল আকাশের মাঝে পূর্ণিমার বড় গোল চাঁদ। পাশে ফুটে উঠেছে ‘রাত জাগা তারা’।

বিরাট-অনুষ্কা, ভারতের সেরা রোমান্টি সেলিব্রিটি জুটির বিয়ের এক বছর

একটা অনুষ্ঠান। সারা রাতের। ভোরকে বরণ করে নিতে একটা আস্ত রাত জাগানোর পরিকল্পনা যে ‘প্রলয়’-এর, তাঁর তারিফ করতেই হয়। করলেনও সকলে।

শ্রীজাত-শ্রীকান্তের পথ ধরে মঞ্চে এলেন উপল-অনিন্দ্য। চন্দ্রবিন্দুর দুই ‘জুজু’ ডেকে নিলেন জোজোকে। তিনি উঠেই রাতের গানে মাতিয়ে দিলেন। সঙ্গে ইংরেজি গান শোনালেন সো‌না। বড্ড মন কেমন করিয়ে দিলেন তাঁর ‘ফার্নান্দো’ এবং ‘স্টারি স্টারি নাইট’ দিয়ে। অনিন্দ্যর মজাদীপ্ত কথা গানের বিনুনিতে যেন চুলের কাঁটা। এক্কেবারে ‘টাইট’। রাত তখন দুটো। অনিন্দ্যরা নেমে যাচ্ছেন। যাওয়ার আগে গাইছেন, ‘ইয়ে রাতে, ইয়ে মওসম, নদী কা কিনারা, ইয়ে চঞ্চল হাওয়া…’। সঙ্গী মেয়েটি অনিন্দ্যর সঙ্গে হামিং করলেন। আহা সে এক অপূর্ব মুহূর্ত। রাতের নজরুল মঞ্চ মনে করিয়ে দিচ্ছে সুমনের সেই গান, ‘জাগে জাগে রাত, জাগে, ভোর হবে বলে…’।

এলেন সোমলতা। চন্দ্রবিন্দুর ‘আমার রাত জাগা তারা’র পেটেন্ট তিনি এখন অনিন্দ্যর কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছেন। গাইলেন। তবে তেমন জমল কোথায়! ‘ভিন দেশি তারা’ অনিন্দ্য এসেও গানের শেষে হাল ধরেও শেষ রক্ষা হল না। বরং লগ্নজিতা কাঁপিয়ে দিলেন। ঠান্ডা লাগা গলাতেও যে ভাবে লতা মঙ্গেশকর শোনানোর রিস্ক নিলেন! এবং উতরেও গেলেন চমৎকার ভাবে— ‘লাগ যা গলে, কে ফির ইয়ে, হাসি রাত হো না হো…’— সাবাশ লগ্নজিতা!

‘শুঁয়োপোকা’ ব্যান্ড খুব শিগগিরি প্রজাপতি হবে। রাতের নজরুল মঞ্চ যে ভাবে তাদের গানকে অভিনন্দন জানাল, তাতে আর বেশি দেরি নেই। ‘বল কবে হবে মিলন… ভাবছি চাঁদে যাব, তোকে নিয়ে হানিমুনে’— এ গান তাঁরা যখন মঞ্চে গাইছেন, রাত তিনটের দর্শকাসন তখন রীতিমতো উত্তেজিত।

মাঝরাতের শ্রোতা ‘জোছনা করেছে আড়ি…’ শোনে কি না দেখার একটা ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করলেন মধুমন্তী বাগচী। শোনামাত্রই যে ভাবে শ্রোতারা তাঁকে অব্যর্থনা জানালেন, তিনি নিজেও এতটা ভেবে উঠতে পারেননি। বড় অদ্ভুত মায়াবী একটা সুর লুকিয়ে ছিল মধুমন্তীর গলায়। রোহনের বেহালার ছড় যেন সেই সুর নিংড়ে আনল। ভর্তি অডিটোরিয়াম করতালিতে মুখর তখন।

তার আগেই আর এক বাগচী, মানে রূপঙ্কর, জমিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। তিনি যখন দর্শকদের অনুরোধে কিছুতেই ‘ও চাঁদ’ গাইবেন না বলে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করেছেন, তখন অডিটোরিয়াম থেকে চিৎকার জুড়লেন গায়ক শিলাজিৎ। শেষে ‘ও চাঁদ তোর জন্মদিনে ভতকা খাব…’ গাইতেই হল তাঁকে। প্যাসেজে তখন শিলাজিৎ নাচছেন।

অনুষ্ঠানে নানা মুহূর্ত…

এর মধ্যেই গান গেয়েছে ‘ব্যান্ডোবিস’। চার বান্ধবীর ব্যান্ড। সুলগ্না বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর বান্ধবীরা যে ভাবে মাঝরাতে গাইলেন ‘ডিস্কো দিবানে, আহা, আহা…’, তাতে একটা জিনিস স্পষ্ট, ভবিষ্যতে অনেক দূর যাবে এই ব্যান্ড এবং কন্যারাও। কারও সুরে কোনও খেলাপ নেই। একসঙ্গে একই উৎসাহে গাইলেন চার কন্যা। সুলগ্নাদের প্রেজেন্টেশন এত পরিশীলিত, বলতেই হয়, কোনও কথা হবে না বস!

কোথায় যেন লুকিয়ে ছিলেন কিঞ্জল চট্টোপাধ্যায়। প্রায় ঘুম থেকে ডেকে তুলে এনে শিলাজিৎ তাঁকে দিয়ে গাওয়ালেন। কিন্তু, সেই ঘুম জড়ানো চোখেই, গলাটা একেবারে পারফেক্ট। ‘রাত নশিলি, মস্ত সামা হ্যায়… ভুল কই হমসে না হো যায়ে’, বেড়ে গলা বটে এই কিশোরের। একের পর এক অনুরোধ। কিন্তু গুনে গুনে তিনটে গানই গাইলেন।

দেবদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরোদে শিলাজিৎ শুরু করলেন অনুষ্ঠান। কথা দিয়েছেন, ‘ভোর দেখিয়েই ছাড়ব!’ প্রথমেই তাঁর বাবার লেখা গান, ‘দিনে রাতে নেই চোখে ঘুম… প্রেম যেন ওয়েসিস, তাকলামাকানে’। ভোর হয়ে গিয়েছে তত ক্ষণে। সরোবরের জলে কুয়াশার সর নেমে এসে চুম্বন করছে। পৌনে ছ’টা। হালকা হিমেল হাওয়া খোলা দরজা দিয়ে ভেসে আসছে। মঞ্চে তখন সকলে মিলে গাইছেন, ‘ছেঁড়া ঘুড়ি, রঙিন বল…’। হঠাৎ পাল্টে গেল শেষটা, ‘বন্ধু তোমায় এ গান শোনাব ভোরবে‌লায়…’।

অপরূপ এক সকাল নেমে এল কলকাতায়। উৎসব শুরুর সকাল। রাত জেগে ভোরকে বরণ করে নেওয়ার একটা সন্ধি-মুহূর্ত। শুরু হয়ে গেল বছর শেষের উৎসবের পালা। কয়েক রাত পোহালেই বড়দিন। আসছে নতুন বছরও। বাঙালি পিছিয়ে নেই। বরং টক্করে সে বিশ্বকে পেছনে ফেলে দিয়েছে।

শীতের সঙ্গে উৎসবের প্রলেপ পড়ল শহরের শরীরে। মেতে উঠল কল্লোলিনী কলকাতা, আমাদের ‘রাত জাগা তারা’

বিরাট-অনুষ্কা, ভারতের সেরা রোমান্টি সেলিব্রিটি জুটির বিয়ের এক বছর