ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি আর বেচবে না ত্বকের রং, নাম থেকে বাদ যাচ্ছে ‘ফেয়ার’

ফেয়ার অ্যান্ড লাভলিফেয়ার অ্যান্ড লাভলি-র সেই বিজ্ঞাপন।

জাস্ট দুনিয়া ব্যুরো: ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি নাম পাল্টাচ্ছে। নিজেদের ওই প্রোডাক্টকে এ বার ‘বর্ণহীন’ করার কথা জানাল ‘হিন্দুস্তান ইউনিলিভার লিমিটেড’। ফর্সার সঙ্গে সুন্দরের সম্পর্ককে জোরালো ভাবে তুলে ধরেই এত দিন ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি নামের ফেয়ারনেস ক্রিমের বিপনন করত তারা। কিন্তু, সেই সুন্দরের গা থেকে এ বার তারা মুছে ফেলতে চায় ফর্সার তকমা। কিন্তু তাতে কি ফর্সা শব্দের সামাজিক ঔজ্জ্বল্য ম্লান হবে? বা কালো রং কি সামাজিক ভাবে কিছুটা হলেও উজ্জ্বল হবে?

সম্প্রতি হিন্দুস্তান ইউনিলিভার লিমিটেডের তরফে জানানো হয়েছে, তারা সৌন্দর্যের বিবিধতায় বিশ্বাসী। ফলে, বর্ণ নির্বিশেষে সব ধরনের ত্বকের যত্নের ক্ষেত্রেই তারা দায়বদ্ধ। সে কারণেই ‘ফেয়ারনেস’, ‘হোয়াইটনিং’ এবং ‘লাইটেইনিং’ এই তিনটি শব্দ তাদের প্রোডাক্ট থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। একই সঙ্গে পাল্টানো হবে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ব্র্যান্ডের নামও।

বাণিজ্য সংক্রান্ত আরও খবর পড়তে ক্লিক করুন

বহু দশক ধরে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি সৌন্দর্যের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে ফর্সা শব্দটিকে জুড়ে দিত। ত্বকের রং কালো থেকে কী ভাবে ধীরে ধীরে ওই ক্রিমের প্রভাবে ফর্সা হয়ে ওঠে সেটাই দেখানো হত বিজ্ঞাপনে। শুধু তাই নয়, ওই ফর্সা রঙের কারণে সামাজিক ক্ষেত্রে কী ভাবে এক জন নারী সফল এবং সর্বজনগ্রাহী হয়ে ওঠেন, ফেয়ার লাভলির বিজ্ঞাপনের সেটাই ছিল মূল উপজীব্য।

ফলে, ভারতীয় উপমহাদেশের একটা বড় অংশের কাছে ওই বিজ্ঞাপনের বড় ‘প্রভাব’ ছিল। সমাজ বিশ্লেষক গার্গি চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘ভারতীয় উপমহাদেশের একটা বড় অংশের মানুষের স্বাভাবিক ত্বকের রংই কালো-ঘেঁষা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ফলে ওই কালো রংকে আমাদের সমাজ সৌন্দর্যের সংজ্ঞার মধ্যে জায়গাই দেয়নি কোনও দিন। সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে এই ফেয়ারনেস ক্রিম তৈরি করা কোম্পানিগুলো ব্যবসা করে গিয়েছে। কালো হতে চেয়েছে ফর্সা। আর ফর্সারা আরও আরও ফর্সা। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি যদি তাদের নাম থেকে সেই ফর্সা শব্দটাই সরিয়ে দেয়, তা হলে বুঝতে হবে আমাদের সামাজিক-কালো কিছুটা হলেও উজ্জ্বল হবে।’’

সমাজের কতটা গভীরে প্রোথিত এই কালো-ফর্সার শিকড় তা বোঝা যায়, সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরনো তরুণী সায়নী দত্তের কথায়। বছরখানেক আগে সাংবাদিকতা নিয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ‘‘সাংবাদিকতাকে পেশা করার কথা ভাবার আগে নিজেকে মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার গায়ের রং যে হেতু চাপা…’’— এটুকু বলেই হেসে ফেললেন। সায়নী বলছেন, ‘‘দেখেছেন নিজের গায়ের রংকে চাপা বলে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছি। এটাই আসলে আমাদের মনের ভেতর গেঁথে দেওয়া হয়েছে। আসলে আমার গায়ের রং কালো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটা ছোট বিজ্ঞাপনের সাইড রোলে কাজ জুটেছিল। তার পর থেকে আর কোনও ডাকই আসেনি। আমি অনেককে বলেছিলাম। প্রোফাইল বানানোর সময় ফোটোগ্রাফাররাও বলতেন, আমার স্কিনের শেডটা নাকি অন্য রকম। এক জন তো আমার গায়ের রংটা খুব সেক্সি-ও বলেছিলেন। কিন্তু, কাজ পাইনি।’’ ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি প্রসঙ্গে সায়নীর মত, ‘‘এই নামবদল যদি ওরা করে, তা হলে একটা বড় লড়াইয়ের খুবই ছোট্ট একটা ধাপ আমরা এগোলাম বলা যেতে পারে। আমাদের মনের ফর্সার যে বর্শা গেঁথে আছে, সেটা সরাতে না পারলে, নামে কী আসে যায়!’’

সংবাদপত্রে শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনে খুবই জনপ্রিয় পাত্রপাত্রী বিভাগ। বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করার জন্য একটা বড় অংশের মানুষ প্রাথমিক ভাবে এই বিজ্ঞাপনের উপরেই ভরসা করেন। একটি বাংলা দৈনিকের তেমনই একটি শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনগ্রহণ কেন্দ্রের কর্মী নির্মল আচার্য। তিনি বলছেন, ‘‘এখন অনেক ম্যাট্রিমনি সাইট হয়েছে। তা সত্ত্বেও কিন্তু মানুষ আমাদের কাছে বিজ্ঞাপনের জন্য আসেন। লকডাউন এবং করোনা পরিস্থিতিতে বাজার যদিও একেবারেই মন্দা, তা-ও খবরের কাগজের ওই বিজ্ঞাপনে আস্থা আছে মানুষের এখনও। সেখানেও দশকের পর দশক ধরে দেখছি, পাত্রী ফর্সা বা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা লেখা হয়। কেউ কালো শব্দটা লেখেন না। তা হলে তো পাত্র জুটবে না। এটা পাত্রের বেলায় খুব কম লিখতে দেখেছি। আসলে আমাদের কাছে ফর্সা রং অনেক গুরুত্ব পায়। নিজেদের অজান্তেই সেটা তৈরি করে ফেলেছি। তাই ক্রিম বিক্রেতারাও কালোকে ফর্সা করার টোপ দিয়ে যায়। আমরাও সেই টোপ গিলে গিলে ফর্সা আর হতে পারলাম না। ফলে কালো-ফর্সার ফারাকটা রয়েই গিয়েছে। আমি এটাকে বদলানোর শুরু বলতে পারছি না। এটাও হয়তো বিজ্ঞাপনী কায়দা একটা ওদের।’’


(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)

বিষয়টিকে শুধুই ‘বিজ্ঞাপনী কায়দা’ হিসেবে দেখতে চাইছেন না বাজার বিশেষজ্ঞ শান্তনু চক্রবর্তী। একটি বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করা শান্তনু বলছেন, ‘‘হিন্দুস্তান ইউনিলিভার লিমিটেড যদি ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি-র মতো এত দীর্ঘ দিনের একটা প্রোডাক্টের নাম থেকে ফেয়ার শব্দটা বাদ দিয়ে দেয়, তা হলে ওই প্রোডাক্ট বিক্রির ক্ষেত্রে সেটা কিন্তু একটা বড় ঝুঁকি। কারণ, ওই ফেয়ার অর্থাৎ ফর্সার জন্যই এত দিন প্রোডাক্টটা বিক্রি হয়েছে। সেটাই যদি না থাকে, তা হলে লোকে কিনবে কেন? সেই ঝুঁকি হিন্দুস্তান ইউনিলিভার লিমিটেড কেন নিতে যাবে? কাজেই এটা বিজ্ঞাপনী কায়দা বলে আমার মনে হয় না। এটা ওরা সামাজিক কারণেই করতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে।’’

বিজ্ঞাপন দেখে ফর্সা হওয়ার এই হাতছানি অনেকের কাছে লোভনীয়। কাজেই ফর্সা হওয়ার লোভ জাগানো বিজ্ঞাপন বা নামওয়ালা ক্রিম বিক্রি বন্ধ হলে সামাজিক সমস্যাও অনেকটা কমবে বলছে বলে মনে করছেন ত্বক বিশেষজ্ঞ সুদীপ ঘোষ। ওই চিকিৎসকের কথায়, ‘‘আমার চেম্বারে প্রতি দিন অন্তত ৪-৫ জন আসেন, যাঁরা ফর্সা হওয়ার ক্রিমের নাম লিখে দিতে বলেন। তাঁদের বলে বোঝানো যায় না, ও ভাবে ক্রিম মেখে ফর্সা হওয়া যায় না। বিজ্ঞাপনী প্রলোভন যদি বন্ধ হয়ে যায় বা প্রোডাক্টের নাম থেকে যদি ফর্সা শব্দটিই বাদ দেওয়া হয়, তা হলে সামাজিক ব্যাধিও কিছুটা হলেও দূর হবে। আমার অন্তত তেমনটাই মনে হচ্ছে।’’